আজ ৯ ডিসেম্বর। পাইকগাছার কপিলমুনি রাজাকার
মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের এ দিনে। দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টার সম্মুখ সমর
যুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর রাজাকারদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে পতন
ঘটেছিল দক্ষিণ খুলনার সবচেয়ে সমালোচিত ও বড় রাজাকার ঘাঁটিটির।
 |
রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর এই বাড়ীতে গড়ে তোলা হয়েছিল পাক দোসর রাজাকারদের দক্ষিণ খুলনার সবচেয়ে বড় দুর্গ |
এ সময় উপস্থিত হাজার হাজার জনতার রায়ে ১৫৬ জন রাজাকার কে সারিবদ্ধ ভাবে
দাঁড়িয়ে দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুদ্ধকালীন এত সংখ্যক রাজাকারদের
জনতার রায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা সম্ভবত সেটাই প্রথম।
তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দোসররা সারা দেশব্যাপী সাধারণ নিরিহ
মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন চালাতে থাকে। আর এ অত্যাচারে
অতিষ্ঠ হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মত পাইকগাছার সর্বত্র প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে
উঠে। এ সময় পাক দোসররা ব্যাপক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘাঁটি করে
কপিলমুনিতে। অত্যাচারের শিকার বহু পরিবার সে সময় দেশের মায়া ত্যাগ করে
উদ্বাস্তু হয়ে পাড়ি জমায় ভারতে।
কপিলমুনির প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব
বিনোদ বিহারী সাধুর সুরম্য বাড়িটি পাকিস্তানি দোসররা দখলে নিয়ে ঘাঁটি করে
সেখানে। তখন এলাকায় তাদের নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। প্রতিদিন বিকাল ৪
টা থেকে ভোর ৬ টা নাগাদ কারফিউ জারী করা হত। এলাকার নিরীহ মানুষদের ধরে
এনে কপোতাক্ষ নদীর তীরে ফুলতলা নামক স্থানে নিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে কেটে
লবন দেয়া হত। বহুজনকে এভাবে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে তারা।
এ সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাইকগাছার রাড়ুলী, বাঁকা, বোয়ালিয়া ও গড়ইখালী
এলাকার প্রতিরোধ দুর্গসমূহকে মুক্তিফৌজের ক্যাম্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
তাগিদ পড়ে কপিলমুনি শত্রু ঘাটি পতনের। কারণ খুলনাঞ্চলের মধ্যে কপিমুনির
শত্রু ঘাঁটি ছিল সবচেয়ে বড় এবং তাদের নির্যাতনের মাত্রাও ছিল বেশী। সাড়ে
৩শর বেশী পাক সেনা ও তাদের দোসররা এখানে অবস্থান নিয়েছিল। ছাদের উপর তাক
করা হয় ভারী কামান ও মেশিন গান।
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর
খুলনাঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ একত্রে মিলিত হন মাগুরার শান্তি
বাবুর দোতলায়। সিদ্ধান্ত হয়, যে কোন মূল্যে কপিলমুনিকে শত্রু মুক্ত করতেই
হবে। এর আগে আরো একবার শত্রু ঘাটি আক্রমন হলেও জনতার অসহযোগিতায় সেবার
ব্যর্থ হয়।
পাইকগাছার রাড়ুলী ও হাতিয়ারডাঙ্গা ক্যাম্প কমান্ডারগণ
যুদ্ধের একটি পরকল্পনা প্রণয়ন করেন। নৌ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী
রহমত উল্লা দাদু, স.ম বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, গাজী রফিক, ইউনুস
আলী ইনু, ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, শেখ আব্দুস সালাম,
আবুল কালাম আজাদ কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।
অবশেষে
তাদের যৌথ নেতৃত্বে ৭ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চারিদিক থেকে কপিলমুনি শত্রু ঘাটি
আক্রমন করা হয়। হঠাৎ রাইফেলের গুলির ঠাশ-ঠাশ আওয়াজ, ভারী অস্ত্র, কামান,
মেশিনগানের বিকট শব্দে মুহুর্তে গোটা এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিপরীত দিক
থেকে অর্থাৎ রাজাকার ঘাটি থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির পাল্টা জবাব আসতে
থাকে।
এ সময় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী দু’মুক্তিযোদ্ধা শেখ আনোয়ার
হোসেন ও আনসার আলী গুলি করতে করতে ঘাটির একেবারেই সন্নিকটে চলে যায়।
আকস্মিক বিরুদ্ধ শিবিরের দিক থেকে আসা একাধিক বুলেট তাদের বুক বিদির্ন করে।
ব্যাপক গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় এলাকাবাসীর। যার যার মত বাড়ীর
বারান্দা বা পাশের আগে থেকে খুড়ে রাখা বাঙ্কারের মধ্যে আত্মরক্ষায় লুকিয়ে
পড়ে।
দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধ শেষে পরাজয় নিশ্চিত জেনে ৯ ডিসেম্বর
বেলা ১১ টার দিকে অস্ত্র ফেলে সাদা পতাকা উচিয়ে ১৫৬ জন পাকিস্তানি দোসর
আত্মসমার্পণ করে। সাথে সাথে পতন ঘটে খুলনাঞ্চলের বৃহত্তর শত্রু ঘাটির।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায় আত্মসমর্পনের পর মুক্তিযোদ্ধারা
রাজাকার ঘাটিতে ঢুকে তালার মাছিয়াড়া এলাকার জনৈক ব্যক্তিকে দেওয়ালের গায়ে
পেরেকবিদ্ধ ঝুলন্ত মৃত অবস্থায় দেখতে পায়, উদ্ধার হয় বহু মাদকদ্রব্য।
শত্রুদের বন্দী করে নিয়ে আসা হয় কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের ঐতিহাসিক
ময়দানে। এখবর ছড়িয়ে পড়লে, এলাকার হাজার হাজার জনতার ঢল নামে সেখানে। এ সময়
জনতার ব্যাপক দাবির প্রেক্ষিতে তাদেরকে প্রকাশ্য জনতার আদালতে গুলি করে
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা শেখ
আনোয়ার হোসেন ও আনসার আলী, আহত হন মোহাম্মদ আলী, তোরাব আলী সানা সহ অনেকে।
অথচ যুদ্ধকালীন সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কপিলমুনি মুক্ত
দিবসের সঠিক দিন ক্ষণ নিয়েও দীর্ঘদিন যাবৎ মুক্তিযোদ্ধাদের দু’পক্ষের মধ্যে
ছিল মতবিরোধ। এক পক্ষের দাবী ছিল ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয় কপিলমুনি আর এক
পক্ষের দাবী ৯ ডিসেম্বর। একবার ৭ ডিসেম্বর বেশ ঘটা করেও পালিত হয়েছিল
দিবসটি। তবে সর্বশেষ মতবিরোধ উপেক্ষা ও উপযুক্ত প্রমানাদি দাখিলের পর ৯
ডিসেম্বর প্রায় সকলেই স্বীকার করে নেন ‘কপিলমুনি মুক্ত দিবস’ হিসেবে।