Friday, November 14, 2014

পাইকগাছায় ডায়াবেটিসে ভুগছে ৩০ হাজার মানুষ

রোগ প্রতিরোধ ও জনসচেতনায় ভূমিকা রাখছে ডায়াবেটিস সেন্টার


পাইকগাছায় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা। বর্তমানে উপজেলায় নিরব এ ঘাতকে ভুগছে ৩০ হাজার মানুষ। জটিল এ রোগ প্রতিরোধ ও জনসচেতনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পাইকগাছা ডায়াবেটিস সেন্টার। আজ ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে পাইকগাছা ডায়াবেটিস সেন্টারের পক্ষ থেকে র‌্যালী, সেমিনার, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ আয়োজন করা হয়েছে নানান কর্মসূচী। 

পাইকগাছায় প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিস আক্রান্ত !




বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়াবেটিস একটি নিরব ঘাতক। যার কারণে হৃদরোগ, ব্রেণ স্ট্রোক, কিডনী রোগ, পায়ে পচন ধরা, চোখের অসুখ ও যৌণ ক্ষমতা কমে যাওয়া বহুগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০ হাজার মানুষ নিরব এ ঘাতকে আক্রান্ত।

এক সময় সচেতনার অভাবে এ রোগ পুশে রাখত অধিকাংরাই। নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ত আক্রান্তকারীরা। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে কেউ যাতে মৃত্যুবরণ না করে এ লক্ষ্যেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোহাঃ শেখ শহীদউল্লাহ ২০১৩ সালে উপজেলা সদরে প্রতিষ্ঠা করেন পাইকগাছা ডায়াবেটিস সেন্টার। সেন্টারটিতে গত ১ বছরে নিয়মিত রোগীর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৪০০ এবং অনিয়মিত রোগীর সংখ্যা হাজারেরও অধিক বলে জানিয়েছেন সেন্টার ইনচার্জ শেখ সেলিম।

সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডাঃ মোহাঃ শেখ শহীদুল্লাহ জানান, ডায়াবেটিস একটি নিরব ঘাতক। খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা ৬.১ থেকে মিঃ মোল/লিঃ থেকে ৭.০ মিঃ মোল/লিঃ এবং খাওয়ার পর ৭.৮ থেকে মিঃ মোল/লিঃ থেকে ১১.০০ মিঃ মোল/লিঃ এর বেশী হলে সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

তিনি বলেন, যে সকল মানুষ নিয়মিত ব্যায়াম করেন না অপেক্ষাকৃত বেশী ওজনধারী, অপরিমিত খাবার খান, নিয়মিত ধুমপান করেন, বংশে ডায়াবেটিস আছে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন তাদের ডায়াবেটিস জনিত অসুখের পরিমাণ বেশী হয়। ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিস জনিত জটিলতায় প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায় বলে তিনি জানান।

ডায়াবেটিস সেন্টারের মাধ্যমে গত ১ বছরে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক সময় মানুষ এ রোগ পুশে রাখত। বর্তমানে বছরে একবার হলেও এলাকার মানুষ ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন। পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে ব্যায়াম বা হাটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।

আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বানের মধ্য দিয়ে আজ ১৪ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০১৪। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘প্রাতঃরাশেই শুরু স্বাস্থ্যকর খাদ্যের’। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। আর বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪০ কোটি। যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হল বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্বময় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি ক্যাম্পেইন, যা প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায়,বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং জন্ম নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।

২০০৭ সালে সিদ্ধান্ত হয়, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ অভিযান পরিচালনার থিমটি আরও দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০০৭-০৮ এর থিম নির্ধারিত ছিল ‘শিশু ও তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস’। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের থিম নির্ধারিত হয়েছে, ‘ডায়াবেটিস শিক্ষা ও প্রতিরোধ’।

এ দিবসের নীল বৃত্তের ‘লোগো’টি ডায়াবেটিসকে পরাভূত করার জন্য বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের সূচক। লক্ষ্য হলো, পৃথিবীতে কোনো শিশুই যেন ডায়াবেটিসে মারা না যায়। ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগ ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, এমনকি সারা পৃথিবীর জন্য গুরুতর ঝুঁকি বহন করে -এমন সত্যটি জাতিসংঘ অনুধাবন করে ২০০৬ সালে একে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পৃথিবীতে ২৫০ মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস নিয়ে জীবন যাপন করছে।

পাইকগাছায় ঔষধ স্বল্পতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা

নিরাপদ পানি বঞ্চিত ৩৩ ভাগ মানুষ; সেনিটেশনের বাইরে ১৭ ভাগ


পাইকগাছায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ঔষধ স্বল্পতা এবং অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৫টি এলাকায় এখনো গড়ে উঠেনি কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে ওই সব এলাকার ৫০ হাজার মানুষ। এলাকাবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনা বৃদ্ধি পেলেও এখনও ১৭ ভাগ মানুষ অস্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার করছে। নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত রয়েছে ৩৩ ভাগ মানুষ। যার কারণে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বাস্তবমুখী পদক্ষেপে গত কয়েক বছর এলাকায় শিশু ও মাতৃ মৃত্যু নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।


সূত্র মতে, জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত পাইকগাছা উপজেলা। উপজেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। উপজেলার বিপুল এ জনসংখ্যার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত হিমসিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, ৪টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৬টি সাব উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ৩৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ২২১টি গ্রামের সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।

সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ২৯ প্রকার ঔষধ সরবরাহ করা হয় বলে উপজেলা স্বস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ আবুল ফজল দাবী করলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ, যে পরিমাণ ঔষধ সরবরাহ করা হয় সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ঔষধ স্বল্পতার পাশাপাশি রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্যা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংকট।

উপজেলার লতার তেতুলতলা, সোলাদানা, সোনাখালী, লস্কর, গড়ইখালী, কুমখালী ও পাতড়াবুনিয়ায় এখনও পর্যন্ত গড়ে উঠেনি কোন কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হয় ৫ হাজার মানুষকে। কুমখালী গ্রামের আব্দুল লতিফ জানান, নিকটবর্তী কোন সেবা কেন্দ্র না থাকার ফলে বাধ্য হয়ে অনেকটা পথ পাড়ী দিয়ে পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রে যেতে হয়। এলাকাবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন ২০০-৩০০ লোকের আগমন ঘটে। ক্লিনিকগুলোতে ১ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইটার সপ্তাহে ৬ দিন, একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী ৩ দিন এবং একজন স্বাস্থ্য সহকারী ৩ দিন সেবা প্রদান করে থাকেন।

সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় মোট জনসংখ্যার ৮৩% মানুষ স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহারের আওতায় আসলেও এখনও ১৭ ভাগ মানুষ খোলা জায়গা ব্যবহার করে আসছে। অগভীর নলকুপ, রেইন ওয়াটার, হারভেস্ট এ টি.এস.এফের মাধ্যমে ৬৭ ভাগ মানুষের নিরাপদ খাওয়ার পানি ব্যবস্থা থাকলেও ৩৩ ভাগ মানুষ অনিরাপদ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে বলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী শেখ সরফরাজ আলী জানান।

সক্ষম দম্পত্তি সহ সাধারণ মানুষকে সচেতন করার ফলে গত কয়েক বছর এলাকায় কোন শিশু ও মাতৃমৃত্যু নেই বলে দাবী করেছেন সাবেক উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শুকলাল বৈদ্য।

নতুন নতুন স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন, জনবল বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ ও জরাজীর্ণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র সমূহ অবকাঠামো সংস্কার করার মাধ্যমে এলাকার শতভাগ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।