আবুল বাজনদারের শেষ অপারেশন আমরা করে ফেলেছি গত ১২ জুলাই। তার শরীরে আর অপারেশন করার পরিকল্পনা নেই আমাদের। তবে তার যে রিপোর্টগুলো এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরের অংশে সমস্যাটি আবারও ফিরে আসতে পারে, তার এটা বারবারই হতে পারে। সেগুলো নিয়ে আমরা শঙ্কিত, তাই তাকে নিয়মিত ফলোআপে রাখতে হবে চিকিৎসার স্বার্থেই।
বৃক্ষমানব বলে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া আবুল বাজনদারের ব্যাপারে এ তথ্য দেন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন। আবুল বাজনদারকে নিয়মিত ফলোআপে রাখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, নির্মাণাধীন নতুন হাসপাতালে (নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) চাকরি দিয়ে তাকে রেখে দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি আমরা। তাহলে বাজনদার আমাদের নিয়মিত ফলোআপে থাকবে, চোখের সামনে থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুলাই বিরল রোগে আক্রান্ত আরেক শিশু সাতক্ষীরার মুক্তামনিকে দেখতে যান জাতীয় টেস্ট ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। সেসময় ডা. সামন্ত লাল সেনের কক্ষে আলাপচারিতার সময় তিনি আবুল বাজনদার সম্পর্কে জানতে চান। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘‘মুশফিক আমাকে বলেন, ‘স্যার, আমি জানি বাজনদারের সম্পর্কে, কিন্তু এটা কী রোগ আর কী করে হলো সেটা জানতে চাই। তখনই বাজনদারকে আমার কক্ষে নিয়ে আসার জন্য বলি।’’
এ প্রতিবেদকের সামনে সেখানেই দেখা হয় বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও আবুল বাজনদারের সঙ্গে। আবুল বাজনদার মুশফিককে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান মুশফিকুর রহিম। বাজনদারের বাম হাত তখন ব্যান্ডেজ করা আর ডান হাতটি খোলা, একদম স্বাভাবিক। সে হাতেই বাজনদার হাত মেলান মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে।
হাত ভালো হয়ে গেছে বাজনদার মন্তব্য করতেই ডা. সামন্ত লাল সেন পুরনো ফাইল থেকে বের করেন আবুল বাজনদার যেদিন প্রথম বার্ন ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন সেই ছবি। দুই হাতে শেকড়ের মতো মাংসপিণ্ড নিয়ে শীর্ণকায় আবুল বাজনদারের ছবি দেখে বিস্মিত হন মুশফিক।
এদিকে মুশফিকের দেখা পাওয়ায় আপ্লুত আবুল বাজনদার। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এরকম একজন মানুষকে জীবনে দেখবো সেটা কোনোদিন চিন্তাও করি নাই। উনি আমার হাত ধরে ছিলেন, ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করেছেন। আমার খুব ভালো লাগছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি আবুল বাজনদার ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এরপর কেটেছে দীর্ঘ দেড় বছরের মতো। তবে এই সময়ে বদলে গেছে তার জীবন, ঘটেছে বিশাল পরির্বতন। হতাশাকে পেছনে ফেলে তিনি এখন দেখছেন নতুন জীবনের স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখছে তার পরিবারও। জীবনটা যে এভাবে বদলে যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি ‘বৃক্ষমানব’ নামে পরিচিত বাজনদার।
বিরল রোগ ইপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভ্যারুসিফরমিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৭ বছর বয়সী বাজনদার। তার চিকিৎসায় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে নয় সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়।
বাংলাদেশে বাজনদারই এই রোগের প্রথম রোগী, আর বিশ্বে তৃতীয়। তার চিকিৎসার পুরো খরচ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বহন করছে। ১৫ বছর বয়সে বাজনদারের হাতে ও পায়ে গাছের শেকড়ের মতো মাংসপিণ্ড তৈরি হয়। যে কারণে তিনি পরিচিতি পান ‘বৃক্ষমানব’ হিসেবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাজনদার এখন একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই হাত দিয়ে কলম ধরতে পারেন। নিজ হাতে ধরে পত্রিকা পড়া এবং একমাত্র মেয়েকে কোলেও নিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘দেড় বছর আগেও হাত ছিল ভারী, কিছু ধরতে পারতাম না, নিজে নিজে চলাফেরাও করতে পারতাম না। কিন্তু সময় বদলে গেছে, এক বছর আগের বাজনদারের সঙ্গে আজকের বাজনদারের বিস্তর ফারাক।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পাঁচ তলার একটি কেবিনে আবুল বাজনদারের দিন কাটছে। সেখানে তার সব সময়ের সঙ্গী স্ত্রী হালিমা খাতুন এবং সাড়ে তিন বছরের মেয়ে তাহিরা।