পাইকগাছায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগের চরম বিপর্যয় ঘটেছে। ক্ষমতাসীন
দলটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। গত
১৫ মার্চ নির্বাচনের পরে পাইকগাছায় হয়নি এখনো ফলাফল মূল্যায়ন সভাও। তবে
তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধের আহ্বান পেলে যে কোন নৈরাজ্য রুখে দিতে
প্রস্তুত। এদিকে বিজয়ের পরও পুলিশী হয়রানি অব্যাহত থাকায় তৃণমূলে বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা রয়েছে চাপে।
আ’লীগের ফল বিপর্যয় সম্পর্কে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক
কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, উপজেলা আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সদ্য সাবেক
উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রশীদুজ্জামান দলীয় নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে
একটি বিশেষ শ্রেণী এবং ব্যক্তি বিশেষকে মূল্যায়ন করায় পরাজয়ের মূল কারণ।
অপর দিকে, উপজেলা আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক
মলঙ্গী বললেন, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং দীর্ঘ দিনের পুরাতন কমিটির
নিষ্ক্রিয়তার জন্য এমন ফল হচ্ছে। এছাড়া দলের পদ-পদবীধারী অনেক নেতা-কর্মীরা
শুরু থেকে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত
প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করায়ই এর প্রভাব পড়ে সর্বত্রই।
এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে দল ব্যর্থ হওয়াই পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলেও তিনি মনে
করেন। অবিলম্বে আ’লীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ভেঙ্গে নতুন নেতৃত্ব তৈরি
করার জন্য জেলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গত ১৫ মার্চ পাইকগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান,
ভাইস-চেয়ারম্যান প্রার্থীর চরম ফলাফল বিপর্যয় ঘটে। চেয়ারম্যান পদে আ’লীগ
সমর্থিত প্রার্থী উপজেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ রশীদুজ্জামান বিএনপি
নেতৃত্বধীন জোট সমর্থিত প্রার্থী এ্যাড. স ম বাবর আলীর নিকট প্রায় ২১ হাজার
ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। নির্বাচনে বিএনপি নেতা এড. স ম বাবার আলী ৫৯
হাজার ৩০৪ ভোট, মোঃ রশীদুজ্জামান ৩৮ হাজার ৩৭৮ ভোট পান।
এদিকে,
ভাইস-চেয়ারম্যান পদে জোট সমর্থিত প্রার্থী উপজেলা জামায়াত ইসলামীর আমীর
মাওলানা শেখ কামাল হোসেন ৬০ হাজার ৪৫৬ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী টিকেন্দ্র
নাথ মন্ডল ৩৫ হাজার ১৫৬ ভোট, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোঃ মুজিবর রহমান
সানা ৭ হাজার ৫৫২ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে, মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে জোট
সমর্থিত শাহানারা খাতুন ৫৭ হাজার ৫৫৬ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী আ’লীগ
সমর্থিত দীপ্তি চক্রবর্ত্তী ৩৭ হাজার ৪৫৩ ভোট পান।
পাইকগাছা-কয়রার
সংসদ সদস্য এ্যাড. শেখ মোঃ নুরুল হক সাবেক এমপি (এড. সোহরাব আলী সানা) ও
বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ রশীদুজ্জামানকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
নেতৃবৃন্দ ভাবেননি যে আগামীতে তাদেরকে জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চাইতে হবে।
তাদের একটা জবাবদিহিতা রয়েছে। তারা যে কাজ করেছে তার ভিতর ন্যায়-অন্যায়
মানুষ এক সময় পর্যালোচনা করবে, বিবেচনা করবে এটা কেউ আমলে আনেননি। জনগণের
যে একটা শক্তি আছে এটা তারা বুঝতে পারেননি।
তিনি আরো বলেন, সাবেক
এমপির সাথে উপজেলা চেয়ারম্যান তালমিলিয়ে চলার কারণে সমাজের কাছে
গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। যে কারণে এ পরাজয় হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খুব
শীঘ্র একটি মূল্যায়ন সভা করে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের
বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের কাছে
পাঠানো হবে। তবে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যের ডাক পেলে যেকোন প্রকার নৈরাজ্য
মোকাবেলায় প্রস্তুত বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
উপজেলা আ’লীগের
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ রশীদুজ্জামান তার পরাজয় সম্পর্কে বলেন, দলের
নেতা-কর্মীদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ পরাজয় হয়েছে। বিগত দ্বিতীয় উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনে এবারের বিজয়ী প্রার্থী এ্যাড. স ম বাবার আলী ভোট কারচুপি
করে সামান্য ভোটের ব্যবধানে আমাকে (রশীদুজ্জামান) পরাজিত করলেও আমি এবারের
নির্বাচনে সে পথ অবলম্বন করিনি। জনগণের রায় মেনে নিয়েছি।
অপরদিকে
পাইকগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনটি পদেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট
সমর্থিত প্রার্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও
পুলিশী হয়রানির চাপে রয়েছে ওই বিরোধী শিবিরের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন সংসদ সদস্যের অনুসারীদের
নির্যাতনে অতিষ্ঠ তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাইকগাছা-কয়রা
দু’টি উপজেলা নিয়ে সংসদীয় আসন খুলনা-৬ গঠিত। স্বাধীনতা পরবর্তী জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে এই আসনটিতে চার বার আ’লীগ, দুই বার বিএনপি, দুই বার জাতীয় পার্টি
এবং জামায়াত ইসলামী দুই বার জয়লাভ করে।
থানা বিএনপি’র সভাপতি
আলহাজ্ব এ্যাড. জিএ সবুর বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি’র অন্তঃকোন্দল
নিরাসন হওয়ায় দলীয় নেতা-কর্মীরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে নির্বাচনী মাঠে কাজ
করেছে। ফলে এ বিজয় সহজ হয়েছে।
জেলা বিএনপি নেতা অধ্যাপক সেখ
রুহুল কুদ্দুস বলেন, আমাদের যোগ্য প্রার্থী থাকায় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের
দলীয় নেতা-কর্মীসহ ১৯ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা এক সাথে নির্বাচনে কাজ করায়
জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
পাইকগাছা থানা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক
আলহাজ্ব এ্যাড. আবু সাঈদ বলেন, বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ ১৯ দলীয় জোট
নেতারা এক হয়ে নির্বাচনী মাঠে কাজ করেছেন এবং দ্বিধা বিভক্ত বিএনপি এক
কাতারে আসায় আমাদের এ বিজয় হয়েছে। তবে নির্বাচনের পরে তৃণমূলে আমার
নেতা-কর্মীরা ক্ষমতাসীনদের হুমকী-ধামকী, হামলা-মামলার চাপে রয়েছে।
পৌর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান মনি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক
কারণে এবং আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে এ বিজয় সম্ভব হয়েছে।
জেলা বিএনপি’র উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান
মুক্তিযোদ্ধা এ্যাড. স ম বাবর আলী মহান আল্লাহ শুকরিয়া আদায় করে বলেন, ১৯
দলীয় জোটের সকল নেতা-কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ
করেছেন। এ ছাড়া অধিকার বঞ্চিত মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা হতাশা বিরাজ
করছিল। দেশের চলমান রাজনৈতিক দুরাবস্থা, লুটপাটেরও প্রতিকার চাইছে মানুষ।
উপজেলার উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। মানুষ বিতশ্রদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ দলমত
নির্বিশেষে সকল মহল এ নির্বাচনে তাকে ভোট দিয়েছেন। তিনি উপজেলা পরিষদ
পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।