সুন্দরবনে সম্পদ আহরণ বন্ধ হলে বেকার হয়ে পড়বেন ১৫ লাখ বনজীবী। চলতি বছরের
১৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় বনজসম্পদ আহরণ বন্ধ
করতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর পর থেকেই স্থানীয়দের
মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি
ও বন থেকে মধু, গোলপাতা, জ্বালানিসহ সব ধরনের বনজসম্পদ আহরণ করে জীবিকা
নির্বাহ করেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। তাদের দাবি, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বেকার হয়ে পড়বেন তারা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী
প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৩৩৪
প্রজাতির গাছ, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া
পাওয়া যায়। এত বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী পৃথিবীর আর কোনো ম্যানগ্রোভ বনে
নেই।
বিভাগীয় বন সংরক্ষক (পশ্চিম) জহির উদ্দীন খন্দকার বলেন,
‘জাতিসংঘের শিক্ষা-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) সুন্দরবনকে
বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করায় এর সংরক্ষণের দায়িত্ব বেশ বড় একটি
চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে, যার
পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের সভায় বনের
সম্পদ আহরণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।’
খুলনা
রেঞ্জের কয়রার বনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বংশ পরম্পরায় আমরা বনের ভেতর
থেকে বিভিন্ন সম্পদ সংগ্রহ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করি। আলাদা কাজের
ব্যবস্থা না রেখে সরকার যদি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, তাহলে ভীষণ বিপদে
পড়ব। পরিবারের লোকজন নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হবে।’
গোলপাতা
আহরণে উপজেলার চাটখালী গ্রামের বাচ্চু মিয়ার ১০টি নৌকা রয়েছে। নৌকাপ্রতি ৮
জন করে ১০টি নৌকায় ৮০ জন কাজ করেন। তাদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন
গোলপাতা সংগ্রহ।
বাচ্চু মিয়া জানান, নৌকার মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ
নিয়ে নৌকা বানিয়েছেন। বনজসম্পদ আহরণে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে
ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা অসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া গোলপাতা আহরণ
বন্ধ হলে বনজীবীদের পথে বসতে হবে।
হায়েতখালী বাজারের কাঁকড়া
ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, ‘জেলেদের ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েছি। তারা বন
থেকে কাঁকড়া এনে আমার আড়তে দেন। কাঁকড়া বিক্রির মাধ্যমে অগ্রিম টাকা উসুল
করছি। আহরণ বন্ধ হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
কয়রা উপজেলার বাঘালি
ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রুহুল আমিন সানা সুন্দরবনের কাঠ বহনের কাজে
৫০টি নৌকা নিয়োজিত করেছিলেন ২০ বছর আগে। ১৯৯৫ সালে সুন্দরবন থেকে সুন্দরি
কাঠ আহরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০০৪ সালে নিষিদ্ধ করা হয় গরান কাঠ সংগ্রহ।
ফলে নিরুপায় হয়ে পানির দামে নৌকাগুলো বিক্রি করে দেন সাবেক এই চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘আমার নৌকায় যে সব শ্রমিক ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন বেকার। এদের
বিকল্প কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেনি। বনজসম্পদ আহরণ বন্ধে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে
স্বাগত জানাই। তবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে লাখ লাখ বনজীবী বেকার হয়ে
পড়বেন। অভাব-অনটন দেখা দেবে, কর্মসংস্থান না পেয়ে অনেকেই দস্যুবৃত্তিসহ
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তাই বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে
শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে।’
কয়রা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের
কমান্ডার জি এম মতিউর রহমান বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো। বনের সবুজ
বেষ্টনী সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে।
সরকারের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। তবে বনজীবীদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে
হবে।’
বিভাগীয় বন সংরক্ষক (পূর্ব) আমির হোসেন বলেন, ‘বনজসম্পদ
আহরণের নামে বিভিন্ন সময়ে বনের পশুপাখি হত্যার ঘটনাও ঘটে। এভাবে নিধন চলতে
থাকলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ-মায়া হরিণসহ বিভিন্ন
প্রজাতি বিপন্ন হয়ে যাবে। বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল কমে যাবে। তাই সুন্দরবনকে
রক্ষার জন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুন্দরবন
রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বনজীবীরা যাতে ক্ষতির শিকার না
হন, সে জন্যও করণীয় নির্ধারণ করা হবে। ১৫ লাখ বনজীবীর বিকল্প
কর্মসংস্থানের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আশা করি, তারা বিকল্প
কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।’
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রায় ২০০ বছর আগে থেকেই উপকূলের লোকজন
বনজসম্পদ আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বনজসম্পদের ওপর ভিত্তি
করে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের অবস্থান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫টি জেলায় (খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট,
পিরোজপুর ও বরগুনা)। স্থল ও জল মিলিয়ে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের
বনটি বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪.২ শতাশং এবং সমগ্র বনাঞ্চলের ৪০ শতাংশ।
ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত
করেছে।