Wednesday, February 8, 2017

চিংড়ি চাষের ঝুঁকি এড়াতে বাড়ছে কাঁকড়া চাষ

চিংড়ি চাষ লাভজনক হলেও এতে রয়েছে ঝুঁকি। লাভের আশায় বিনিয়োগের পরও বহু চাষিকে মোটা অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ঘেরের এক ধরনের ভাইরাসের কারণে চাষিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। পশ্চিম উপকূলের খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় আশির দশক থেকে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষে প্রথম দিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও নব্বইয়ের দশক থেকে নানা ধরনের রোগবাইলাই দেখা দিচ্ছে। আর এ কারণে বহু চাষি ঝুঁকি এড়াতে কাঁকড়া চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

চাষিরা জানান, বড় ঘের মালিকেরা চিংড়ি চাষের পাশাপাশি কাঁকড়া চাষ শুরু করেছেন। খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরার দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, তালা, পাটকেলঘাটা, আশাশুনির বুধহাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় খামারে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে।

চিংড়ি চাষে ১০০ বিঘা জমিতে যেখানে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৫ লাখ টাকা লাভ করা কষ্টসাধ্য, সেখানে মাত্র ৫ বিঘা জমিতে দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগে ৫ লাখ টাকা অর্জন সম্ভব বলে চাষিরা জানিয়েছেন।

কাঁকড়া চাষিরা জানান, মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে পুকুরে প্রতি বিঘাতে ৯০০ কেজি থেকে এক হাজার কেজি কাঁকড়া চাষ করা যায়। স্বল্প সময়ে কাঁকড়া চাষে বেশি লাভ করা যায়। প্রায় সারা বছরই কাঁকড়া চাষ হয়। ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া রপ্তানিযোগ্য হয়।

সুন্দরবন আর ঘের থেকে আসা জীবন্ত কাঁকড়াগুলো ঝুড়িভর্তি হয়ে সরাসরি ঢাকা যাচ্ছে। সেখান থেকে রপ্তানি হচ্ছে। ট্রাকে ওঠার আগে কাঁকড়া মজুদ হয় স্থানীয় আড়তে। সাইজ অনুযায়ী মেপে এগুলো গ্রেডে ভাগ করা হয়। এরপর আড়ত থেকেই ঝুড়িভর্তি হয়ে ট্রাকে উঠে পাড়ি জমায় বিদেশে।

পাইকগাছায় এ দৃশ্য নিত্যদিনের। বিদেশের বাজারে অধিক চাহিদাসম্পন্ন এ কাঁকড়া সুন্দরবনসহ এলাকার বিভিন্ন ঘের থেকে ধরা হয়। বিদেশের বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকায় এলাকায় কাঁকড়া ধরায় জীবিকা নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।

পাইকগাছার কাঁকড়ার বাজারসহ পাইকগাছা ও কয়রার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ঘুরে কাঁকড়া চাষি ও সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এক সময় শুধু সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া আহরণ করা হতো। এখন অনেকেই কাঁকড়া ফ্যাটেনিংকে (পুষ্ট করা) জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ এলাকায় কাঁকড়া আহরণের পরিমাণও বাড়ছে।

কাঁকড়া আড়তের মালিকেরা জানান, ক্যাচাররা (যারা কাঁকড়া ধরে) ঘের, নদী ও জঙ্গল থেকে ধরে আনা কাঁকড়া আড়তে নিয়ে আসে। মানসম্মত সাইজের কাঁকড়াগুলো সরাসরি আড়তের মাধ্যমে বাইরে যায়, আর অপুষ্ট কাঁকড়াগুলো ফ্যাটেনিং পদ্ধতির মাধ্যমে ঘেরে কিংবা খাঁচায় বড় করে পূনরায় আড়তে পাঠানো হয়। অপুষ্ট কাঁকড়া ফ্যাটেনিং করার জন্য অনেকে কম দামে এগুলো কিনে নেয়।

স্থানীয় বাজার সূত্র বলছে, পুরুষ কাঁকড়া পাঁচটি গ্রেডে এবং স্ত্রী কাঁকড়া তিনটি গ্রেডে ভাগ করে বেচাকেনা হয়। ৫০০ গ্রাম ওজনের পুরুষ কাঁকড়াগুলো ‘ডাবলএক্সএল’ গ্রেডের। স্থানীয় বাজারে এর প্রতি কেজির মূল্য ৫২০ টাকা। এ ছাড়া ৪০০ গ্রাম ওজনের ‘এক্সএল’ গ্রেড প্রতি কেজি ৪২০ টাকা, ৩০০ গ্রাম ওজনের ‘এল’ গ্রেড প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, ২০০ গ্রাম ওজনের ‘এসএম’ গ্রেড প্রতি কেজি ২২০ টাকা এবং ১৩০ গ্রাম ওজনের ‘এসএসএম’ গ্রেড প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হয়।

পুরুষ কাঁকড়ার চেয়ে স্ত্রী কাঁকড়ার মূল্য বেশি। ১৮০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-ওয়ান’ গ্রেডভুক্ত স্ত্রী কাঁকড়া প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, ১৫০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-টু’ গ্রেডের স্ত্রী কাঁকড়া ৩০০ টাকা কেজি এবং ১২০ গ্রাম ওজনের ‘এফ-থ্রি’ গ্রেডের স্ত্রী কাঁকড়া বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে।

পাইকগাছা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অধিবাস সানা বলেন, আশির দশকে এ অঞ্চলের কাঁকড়া খুলনায় পাঠানো হতো। সেখান থেকে ঢাকায় যেত। আর এখন কাঁকড়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এখান থেকে সরাসরি ঢাকা পাঠানো হয়। এখানকার বাজার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫ টন কাঁকড়া ঢাকার উত্তরায় রপ্তানিকারদের কাছে পাঠানো হয়।

পাইকগাছার লোনাপানি কেন্দ্র সূত্র বলছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে রপ্তানিযোগ্য মৎস্য পণ্যের পরেই কাঁকড়ার স্থান। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন এই লোনাপানি কেন্দ্র থেকে পুকুরে কাঁকড়া ফ্যাটেনিং বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। এরপর থেকেই গবেষণায় পাওয়া কলাকৌশল কৃষক পর্যায়ে প্রয়োগ করা হয়। এরই মধ্যে এ অঞ্চল থেকে পাওয়া ‘শীলা’ জাতের কাঁকড়ার আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারিত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুলনা অঞ্চলে পাওয়া এই ‘শীলা’ জাতের কাঁকড়া সাধারণত ২ পিপিটি লোনাপানিতে সামুদ্রিক পরিবেশে বাস করতে পারে। কিন্তু ৭০ পিপিটির ওপরে এরা বাঁচতে পারে না। বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, খুলনা, নোয়াখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ও সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকায় এই জাতের কাঁকড়া আছে। তবে বেশি পাওয়া যায় খুলনা ও সুন্দরবন এলাকায়।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুয়ায়ী, ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সে কাঁকড়া ডিম দেয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এদের প্রজননকাল। ২০০ থেকে থেকে আড়াইশ’ গ্রাম ওজনের প্রতিটি স্ত্রী কাঁকড়া সাড়ে আট লাখ থেকে পনেরো লাখ ডিম দেয়। আর ডিম থেকে কাঁকড়া হতে সময় নেয় ৩৫ থেকে ৪০ দিন। কাঁকড়ায় আমিষের পরিমাণ ১৯ থেকে ২৪ শতাংশ, স্নেহ জাতীয় পদার্থ ৬ শতাংশ, খনিজ পদার্থ ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং পানি রয়েছে ৭১ থেকে ৭৪ শতাংশ।

পাইকগাছা লোনাপানি কেন্দ্রের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মৎস্য বিশেষজ্ঞ শ্যামলেন্দু বিকাশ সাহা বলেন, কাঁকড়া চাষ বলতে সাধারণত ছোট আকারের কাঁকড়াকে লোনাপানি অঞ্চলের ঘেরে মজুদকরণ, খাদ্য প্রয়োগ, রক্ষণাবেক্ষণ ও আহরণকে বোঝায়। লোনাপানির এলাকায় এই পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের বিষয়ে আমরা চাষিদের সহায়তা দেই।

--রফিকুল ইসলাম মন্টু

'ফটোক তুলি পেপারে দিলি কি ভাতা পাবানে?'

কপিলমুনির হাজারীর ভাগ্যে আজও জুটলো না বয়স্ক ভাতা !


‘কোনোদিন ভাবিনি আজ আমি পথে নামবো, বুড়ো (স্বামী) মরার পর আমি ভিক্ষে করে খাবো। এই শেষ বেলায় মানুষের দোরে না গেলি পেটে ভাত যাবে না এইডা ভাবিনি। শুনি হাসিনা সরকার বুড়ো-বুড়িগে ভাতা দেচ্চে, শুধু শুনি গ্যালাম আমার তো কেউ দেলে না, তালি কি আমার বয়স হয়নি’। --ভিক্ষার ঝুলি আর বাঁকা লাঠি হাতে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া পাইকগাছার কপিলমুনির নগর শ্রীরামপুর গ্রামের হাজারী বিশ্বাস কথাগুলো বলতে বলতে যেন নিজের অজান্তে কেঁদে ফেললেন। কপিলমুনির স্বর্ণপট্টিতে প্রতিবেদকের ক্যামেরা দেখে বলতে থাকেন ‘বাবা ফটোক তুলি পেপারে দিলি কি ভাতা পাবানে?’

পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির পার্শ্ববর্তী নগর শ্রীরামপুর গ্রামের মৃত সুবোল বিশ্বাসের স্ত্রী নব্বই ছুঁই ছুঁই হাজারী বিশ্বাস বড়ই অসহায়। স্বামী ছিলেন দিন মজুর, একযুগ হলো তিনি স্বামী হারিয়েছেন। স্বামী সমিতি থেকে টাকা তুলে একটি ঘর তৈরী করে দিয়েছিলেন, অভাবের সংসারে ঘর ছাড়া কিছু রেখে যেতে পারেননি প্রিয় স্ত্রীর জন্য। হাজারী গত বছর ভাদ্র মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তার শরীরটা মোটেও ভাল যাচ্ছে না। আর সেই থেকেই পেটের ক্ষুধা মেটাতে হাজারী বিশ্বাস ভিক্ষা পেশাটা বেছে নিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ১ ছেলে ও ১ মেয়ের জননী। অভাবের সংসারে ছেলেটা দিন মজুর। মেয়েকে কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে বিয়ে দেওয়া হলেও তার ভাগ্যটাও যেন প্রতিকূল। বিয়ের ৩ দিন পর জামাইয়ের চরম অবহেলায় তার ঘর বাঁধা হয়নি, সেই থেকে অভাগা মেয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন।

হাজারীর পড়ন্ত বেলায় কষ্টের জীবনের গল্পের অংশ বিশেষ, প্রতিদিন সকালে ভিক্ষার ঝুলি আর লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে পড়েন কপিলমুনিসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের দ্বারে। রাস্তাঘাটে যেখানে সুযোগ হয় তিনি একটা রুটি আর একটা বিস্কুট দিয়েই সকাল আর দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলেন। বিকেলে আসরের আযানের সময় তিনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। বাড়ি ফিরে তার মেয়ের হাতের রান্না দু’মুঠো ভাত খেয়ে রাত কাটে তার।

এই হলো কপিলমুনির নগর শ্রীরামপুর গ্রামের হাড়িপাড়ার অবহেলিত ‘হাজারীর জীবনের গল্প’। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আজ একবছর ধরে ভিক্ষে করি, আর ভাল্লাগে না। শরীলডা খারাপ, সরকার কোন দিন সাহায্য আর ভাতাও দেলে না’ কথা গুলো বলে কাঁদতে থাকেন তিনি।

সচেতন এলাকাবাসী বলছেন, সরকার যখন ভিক্ষুকমুক্ত খুলনা জেলা ঘোষণা দিলেন তার কিছুদিন পরেই ভিক্ষার ঝুলি হাতে হাজারীর এমন না পাওয়ার অর্তনাদ। সরকার এমন সব বয়ঃবৃদ্ধ মানুষের জন্য সাহায্য, সহানুভূতি আর ভয়স্কভাতা চালু করলেও আজও সমাজে এমন অসহায় হাজারী’রা সরকারি সহযোগীতা থেকে কি বঞ্চিতই থেকে যাবেন?

--পলাশ কর্মকার, কপিলমুনি, পাইকগাছা।

Voice of Paikgacha