Thursday, November 3, 2016

সু-সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হকের ১৩৪তম জন্মজয়ন্তী

বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে যেসকল বাঙ্গালী মুসলমান মননশীল গদ্য লেখক বিশিষ্টতা অর্জন করেন কাজী ইমদাদুল হক তাদের মধ্যে অন্যতম। শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর তৎকালীন মুসলমান সমাজে তিনি এক ব্যাতিক্রমধর্মী প্রতিভার অধিকারী হয়ে সাহিত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হন। স্বল্প সংখ্যক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করতে সক্ষম হন। তিনি ছিলেন এক ধারার কবি, প্রবন্ধকার, উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। তাঁর অন্যতম রচনা থাকলেও একটি মাত্র অসমাপ্ত উপন্যাস “আব্দুল্লাহ” রচনা করে তিনি যে কৃতিত্বের নির্দেশনা রেখে গেছেন তাই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় করে রেখেছে। 

সু-সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হক ১৮৮২ সালের ৪ নভেম্বর খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার গদাইপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী ইমদাদুল হকের পিতামহ ছিলেন কাজী আজিজুল হক। পিতা কাজী আতাউল হক। তিনি ১৮৪৪ সালে গদাইপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

মেলেক পুরাইকাটী গ্রামে তাঁর নিবাস ছিল। কাজী আতাউল হক প্রথমে আসামে জরীপ বিভাগে চাকরী করতেন। পরে তিনি মুক্তরী পাস করে খুলনা ফৌজদারী আদালতে আইনজীবী ছিলেন। কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন পিতার একমাত্র সন্তান। কাজী আতাউল হক একমাত্র সন্তানের শিক্ষার বিষয় ছিলেন তৎপর। ইমদাদুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের স্কুল ও পারিবারিক পরিবেশে।

গ্রামে থাকাকালীন সময়কালীন সময় কাজী আতাউল হক বই পড়ার আগ্রহে কপোতাক্ষ নদের উপর রাড়ুলী গ্রামের রায় পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হন এবং বিভিন্ন বই পড়ার সুযোগ লাভ করেন। ঐ পরিবারের সদস্য জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এ সময় তিনি পুত্রকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার মনোস্ত করেন। বন্ধুবর প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উৎসাহ ও পরামর্শে কাজী ইমদাদুল হককে ১৮৯০ সালে খুলনা জিলা স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি করেন। ১৮৯৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। ১৮৯৮ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন তিনি পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স নিয়ে ডিগ্রী ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু পরীক্ষার আগে অসুস্থতার কারণে অনার্স পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। এরপর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ে এম,এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি পরীক্ষার আগেই বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হয়ে ১৯০৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসার অস্থায়ী শিক্ষক পদে নির্বাচিত হন। এরপর পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ায় ১৯০৬ সালে আসামে শিলংয়ে শিক্ষা বিভাগে ডিরেক্টরের অফিসে উচ্চমান সহকারী পদে চাকুরী গ্রহণ করেন।

আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে সুদুর প্রবাসে তিনি নিজেকে খাপখাওয়াতে না পেরে এবং স্বাস্থ্যহানীর কারণে দেশে ফিরে আসেন। এ সময় পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের শিক্ষা বিভাগে ডিরেক্টর ছিলেন মিঃ সার্প। কাজী ইমদাদুল হক সার্প সাহেবের স্নেহ দৃষ্টি লাভ করেন এবং ১৯০৭ সালে ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। তখন তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৫০ টাকা। পূর্ব বঙ্গ আসাম প্রদেশের শিক্ষা বিভাগে শিক্ষা ব্যবস্থার আমল সংস্কার সাধনে নতুন শিক্ষা প্রণালী প্রবর্তনে উদ্যোগী হন। শিক্ষার্থীদের কাছে ভূগোল শিক্ষা কিভাবে আকর্ষণীয় করা যায় সে বিষয়ে কাজী ইমদাদুল হকও বিশেষ চিন্তা ভাবনা করেন। তার ভূগোল শিক্ষার একটি আদর্শ শিক্ষা প্রণালী। শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রশংসিত হয়। সেখানে ভূগোল বিষয়ে শিক্ষাদানে বিশেষ দক্ষতা দেখান এবং ভূগোল বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। কিছুকাল করে এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৯১১ সালে ঢাকা টিসার্স ট্রেনিং সেন্টারে ভূগোলের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। টিসার্স ট্রেণিং কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ বিন-এর আগ্রহে বিটি পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেন এবং ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে বিটি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি প্রাদেশিক এডুকেশন সার্ভিসে উন্নীত হয়ে ঢাকা বিভাগের মুসলিম শিক্ষার সহকারী স্কুল ইনসপেক্টরের পদে ময়মনসিংহে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ে নিযুক্ত হন। ১৯১৭ সালে কলকাতার টিসার্স ট্রেনিং স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথম কর্মদক্ষ পদে নিযুক্ত হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।

সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হকের পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মদ দায়েসউল্লাহ স্ব-পরিবারে ইরাকের বাগদাদ থেকে দিল্লীলকে ষ্টোরিয়া এসে বসতি স্থাপন করেন। শেখ মোহাম্মদ দায়েস উল্লাহ সুলতানী আমলে প্রধান বিচারপ্রতি নিযুক্ত হন। বিচার কার্য্যে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তৎকালীন সম্রাট তাঁকে কাজী উল-কুজ্জাতা উপাধিতে ভূষিত করেন। সে সময় ভারতে তুর্ক আফগান শাসনের দেশবাসীর জাতীয় সমর্থন ছিল না। সমগ্র দেশব্যাপী ছিল না কোন সার্বভৌম শক্তি। ক্ষমতা লাভের জন্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কলহ বিবাদে জর্জরিত ছিল। এমন নাজুক অবস্থায় দেশব্যাপী শুরু হয় বিদ্রোহ। মোঘল আমলে বিদ্রোহের সময় ভারতের দিল্লী থেকে তিনটি পরিবার দক্ষিণ বাংলার খুলনা জেলার অন্তর্গত বর্তমান পাইকগাছায় চলে আসেন এবং জঙ্গল কেটে বসবাস শুরু করেন। পরিবার তিনটি হলো- দেওয়ান মানিক রায়ের পূর্ব পুরুষ শেখ মোহাম্মদ দায়েস উল্লাহর বংশধর মুফিজউল্লাহ এবং ঘোষ নবিস পরিবার এবং পূর্ব পুরুষ। জগৎ বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার আচার্য্য প্রফুল্ল রায়ের পূর্বপুরুষ দেওয়ান মানিক রায়।

কাজী ইমদাদুল হকের পূর্বপুরুষ মুফিজ উল্লাহ ও ঘোষ নবিসের পূর্ব পুরুষ শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রকৃতশীল চিন্তা চেতনায় খ্যাত ছিলেন। তাদের সুচিন্তিত ভাব ধারায় দক্ষিণ বঙ্গে গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা। ঐ সভ্যতার উর্বর ভূমিতে বংশানুক্রমে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নাসির উল্লাহ। তাঁর দুই পুত্র কাজী হামিদউল্লাহ ও কাজী মহিবুল্লাহ। কাজী হামিদউল্লাহর তিনপুত্র কাজী সরুর আহমেদ, কাজী আজিজুল হক ও কাজী হামিদুল ইসলাম। কাজী মহিবুল্লাহর একপুত্র কাজী বাশারতউল্লাহ। কাজী সরুর আহমেদের পুত্র কাজী সৈয়েদুল ইসলাম। কাজী আজিজুল হকের পুত্র কাজী আতাউল হক। প্রকৃতশীল চিন্তা ও চেনতায় ধারক কাজী ইমদাদুল হক ১৯০৪ সালে এলাচীপুরের মৌলুভী আব্দুল মকসুদ সাহেবের জ্যৈষ্ঠ কন্যাকে বিয়ে করেন। কাজী ইমদাদুল হকের চারপুত্র ও দুইকন্যা। কাজী আনারুল হক, কাজী সামছুল হক, কাজী আতাউল হক, কাজী নুরুল হক এবং দুই কন্যা জেবুন্নেছা ও লতিফুন্নেছা। বিংশ শতাব্দীর সু-সাহিত্যিক কাজী ইমদাদুল হকের জন্ম ১৮৮২ সালে খুলনা জেলার পাইকগাছার গদাইপুর গ্রামে। পুত্র কাজী আনারুল হক (১৯০৯-২০০১) আমলা টেনকোক্র্যাট উপদেষ্টা মন্ত্রী ও লেখক। বিচারপতি সায়ে, জিয়াউর রহমান এবং বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তিনি ছয় বছর কাল উপদেষ্টা মন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন।

কাজী ইমদাদুল হক ছাত্রজীবনে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। তার সাহিত্য জীবনে সূতপাত ঘটে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। তার প্রথম সাহিত্যকর্ম ৯টি কবিতা সংগ্রহ আঁখিজল ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালের সূচনা লগ্ন থেকে নবনূর, প্রবাসী ও ভারতী পত্রিকাসহ প্রভৃতি পত্রিকায় তার কবিতা ও প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বিভিন্ন কবিতা নিয়ে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ লতিকার পান্ডুলিপি রচিত হলেও তা অপ্রকাশিত থেকে যায়। পরে কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলীতে কবিতা গুলো স্থান পায়। সরলা দেবী চৌধু রাণী সম্পাদিত ভারতী পত্রিকায় কাজী ইমদাদুল হকের মোসলেম জগতের বিজ্ঞান চর্চা শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথমে এ প্রবন্ধনের নাম লেখা ঐসিলামিক জগতের বিজ্ঞান চর্চা। পরে নব নূর সম্পাদন সৈয়দ ইমদাদ আলী পরামর্শক্রমে কাজী ইমদাদুল হক নাম পরিবর্তন করে রাখেন মোসলেম জগতের বিজ্ঞান চর্চা। ১৯০৪ সালে মোসলেম জগতের বিজ্ঞান চর্চা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। কাজী ইমদাদুল হক যে নিজে সমাজ সম্পর্কে উদ্বীগ্ন হয়ে সাহিত্য সাধনা করেছিলেন সে সম্পর্কের ড. আনিচুর জামান মন্তব্য করেছেন। মুসলমান সমাজের অভ্যান্তরিন দূর্বলতা এবং হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে তিক্ততা তাকে প্রথম থেকেই চিন্তিত করে তুলেছিল। তবে সে কালের মুসলমান লেখকদের মত ঐতিহ্য গর্ভ এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানের মনোলিন্যের প্রভাব তাকে স্পর্ম করেছিল। এটা সে যুগের পরিবেশনের ফল বলতে হবে।

১৯৯১ সালে কাজী ইমদাদুল হক ঢাকা ট্রেনিং কলেজের ভূগোল বিষয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। এ সময় তিনি ভূগোল বিষয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। আে সনময় তিনি ভূগোল শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ (দ্বিতীয় ভাগ ১৯১৩ প্রথম ভাগ ১৯১৬) রচনা করেন। ১৯১৭ সালে কাজী ইমদাদুল হক কলকাতা ট্রেনিং স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এ সময় তার শিশু পাঠ্য গ্রন্থ নবী কাহিনী প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এ সমিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সমিতির মূখোপত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। বঙ্গী মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তার চারটি রচনা প্রকাশিত হয় স্বর্গের জ্যোতি, আবর্জনা, সুলমান সালাউদ্দীনও কুরুস্ডে এবং অদ্ভুত চা খোর। ঐ বছরই (১৯১৮) সাল তার প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রবন্ধ মালার প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। মুসলিম জগতের বিজ্ঞান চর্চাসহ মোট ৬টি প্রবন্ধ এই গ্রন্থে সংকলিত হয়। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ নিয়ে দ্বিতীয় ভাগ সংকলনে অভিপ্রায় ছিল বলেই এই গ্রন্থের শিরোনামে প্রথম ভাগ সংযুক্ত হয়। পরবর্তীকালে আব্দুল কাদির সম্পাদিত কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী গ্রন্থে অপ্রকাশিত প্রবন্ধবলী সংযোজিত হয়।

১৯১৮ সালে মুত্রাশয় পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর একটি কঠিন অস্ত্র পাচারের ফলে কাজী ইমদাদুল হককে দীর্ঘ ৬ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। সে সময় তিনি আব্দুল্লাহ উপন্যাস রচনা শুরু করেন। এর ২ বছর পর মোজাম্মেল হক ও আফজালুল হক মুসলিম ভারত পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকায় “আব্দুল্লাহ” উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রায় দেড় বছরকাল মুসলিম ভারতে “আব্দুল্লাহ” প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়া উপন্যাসটি অসমাপ্ত থেকে যায়। এর ইমদাদুল হকের স্বাস্থ্য ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়তে থাকায় উপন্যাসটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। উপন্যাসের ৩০টি পরিচ্ছেদ কাজী ইমদাদুল হক রচনা করেন এবং অবশিষ্ট অংশ টুকু তিনি খসড়া রেখে গিয়েছিলেন। ৩১ থেকে শেষ ৪১ পর্যন্ত অংশের খসড়া কাজী ইমদাদুল হক রেখে গিয়েছিলেন তা অবলম্বনে উপন্যাসটি সম্পন্ন করার দায়িত্বপান কাজী আনারুল কাদির। রেখে যাওয়া ১১টি পরিচ্ছেদের খসড়া অবলম্বন করে কাজী আনারুল কাদির উপন্যাসটি শেষ করেন। আনারুল কাদিরের রচিত অংশের পরিমার্জনা করে কাজী শাহদাত হোসেন। কাজী ইমদাদুল হকের মৃত্যুর পর ১৯৩৩ সালে “আব্দুল্লাহ” উপন্যাস প্রথম গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে আব্দুল কাদিরের সম্পাদনায় কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী প্রকাশিত হয়।

কাজী ইমদাদুল হক আব্দুল্লাহ উপন্যাসে যে বিষয় বস্তু উপস্থাপনা করেছেন সে সম্পর্কে আব্দুল কাদির মন্তব্য করেছেন বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে বাঙালী মুসলমান সমাজে যে অবস্থা ছিল তার একটি নিখুঁত চিত্র আব্দুল্লাহ উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। কাজী ইমদাদুল হক বৈচিত্রপূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টির অধিকারী হলেও তাঁর প্রধান কৃত্বি “আব্দুল্লাহ” উপন্যাস। তাঁর অপরাপর রচনার গুরুত্ব কালের আবর্তে নিঃশেষ হলে গেলেও “আব্দুল্লাহ” উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৯২০ সালে কাজী ইমদাদুল হক শিক্ষক ও শিক্ষা বিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সম্পাদক হিসেবে তিনি এ পত্রিকায় বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশ করেন। শিক্ষক পত্রিকাটি ৩ বছর চালু ছিল। এই পত্রিকায় শিক্ষা বিষয়ক কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কাজী ইমদাদুল হকের কতিপয় পাঠ্যপুস্তক ও রচনাগুলি হল- কবিতা ১। আখিঁজল (১৯৯০), ২। লতিকা (১৯০৩-অপ্রকাশিত), ৩। উপন্যাস আব্দুল্লাহ (১৯৩৩), ৪। প্রবন্ধ- মুসলিম জগতের বিজ্ঞান চর্চা (১৯০৪), ৫। প্রবন্ধ মালা ১ম খন্ড (১৯১৮), ৬। প্রবন্ধমালা ২য় খন্ড (১৯১৬), ৭। শিশু সাহিত্য নবী কাহিনী, ৮। কামারের কান্ড (১৯১৯), ৯। পাঠ্যপুস্তক ভূগোল শিক্ষা প্রণালী (১ম ও ২য় ভাগ-১৯১০) সরল সাহিত্য।

কাজী ইমদাদুল হকের সমগ্র কর্মজীবনই কেটেছে সরকারী চাকুরীতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন কাজে অসামান্য দক্ষ, গভীর দায়িত্ববোধ ও উদ্বোধনী শক্তির স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন বৃটিশ সরকার তাঁকে ১৯১৯ সালে খানসাহেব উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২৬ সালে পুনঃরায় তাঁকে খাঁনবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে সম্মানিত করা হয়।

বিংশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলার মুসলিম সমাজে যেসব সমস্যা, কুসংস্কার পুঞ্জিভূত দেখা যায় আব্দুল্লাহ উপন্যাসখানি তাঁর দুঃসাহসী প্রতিবাদ। এ সময় বাংলার মুসলিম সমাজে আশরাফ-আতরাফ ভেদ, পীর মুরিদী। কঠোর পর্দা প্রন্থা, আধুনিক ইংরেজী শিক্ষার বিরোধিতা, অহেতুক ধর্মীয় গোড়ামি, বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি বিরূপতা, বংশ গরিমার নামে ব্যয়বহুল অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কুসংস্কার সমাজকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়েগিয়েছিল। হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের মধ্যেও তিক্ততা বিরাজ করেছিল। কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাবীদ। সমাজের বিরাজমান সমস্যা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই আব্দুল্লাহ উপনস্যাসে তিনি সামাহিক ব্যাধির একজন নিপুন চিকিৎসকের মত সমাজ বিশ্লেষণ করেছেন এবং রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করেছেন। তিনি কেবল সমস্যা তুলে ধরে ক্ষান্ত হননি সাথে সাথে বিজ্ঞান সম্মত সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আব্দুল্লাহ উপন্যাস পাঠ করে মন্তব্যে লিখেছিলেন, আব্দুল্লাহ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছি। বিশেষ কারণে এই বই থেকে মুসলমানদের ঘরের কথা জানা গেল।

কাজী ইমদাদুল হক কখনো সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না। সারা বছর কোন না কোন অসুখ-বিসুখ লেগে থাকতো। ১৯২৬ সালে তিনি কিডনী রোগে আবারও আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় চিকিৎসায় কোন প্রতিকার না হলে হেকিমী চিকিৎসার জন্য দিল্লির উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন। কলকাতায় অবস্থান করাকালীন ১৯২৬ সালে ৪৪ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী ইমদাদুল হককে গোবরা কবরস্থানে তার মাতার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

এদিকে কাজী ইমদাদুল হকের ১৩৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কাজী ইমদাদুল হক স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে শুক্রবার সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রতিকৃতিকে পূষ্পমাল্য অর্পন, আলোচনা সভা, পদক বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।