স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি পাইকগাছার ঐতিহাসিক কপিলমুনি যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। অরক্ষিত রয়েছে রাজাকারদের ব্যবহৃত রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বসতবাড়ী, এমনকি গণ আদালতের মাধ্যমে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের সামনে যেখানে একসাথে ১৫১ রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, সেখানে আজও স্থাপন করা হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৭১ সালের কপিলমুনির ঐতিহাসিক যুদ্ধের সকল স্মৃতি বিজড়িত স্থান স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের মাধ্যমে সংরণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসী। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজাকারদের আত্মসমর্পণ ও তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মধ্যদিয়ে রাজাকার মুক্ত হয় বাণিজ্যিক শহর কপিলমুনি।
আজকের এ দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। আয়োজন করেছে নানান অনুষ্ঠানের। আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সমিতি কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৮টায় বিজয় র্যালি, সাড়ে ৯টায় পথসভা অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণারপর দেশের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় দণিাঞ্চলেও হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাটে মরিয়া হয়ে ওঠে রাজাকাররা। দণিাঞ্চল পাইকগাছার অন্যতম ঘাঁটি হিসাবে রাজাকাররা ব্যবহার করেন বাণিজ্যিক শহর কপিলমুনির প্রাণ কেন্দ্রেই রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুদের বসতবাড়ী।
বিনোদ বিহারী সাধু ও তার ভাই কুঞ্জু বিহারী সাধু বসতবাড়ীটি ১৯১৬ সালে নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বিনোদ বিহারী সাধু ও তার পরিবার ভারতের কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। আর কপিলমুনির এ বাড়ীতে বসবাস করেন বিনোদের ভাই কুঞ্জু বিহারী সাধু ও তার পরিবার। এলাকার সংখ্যালঘুদের উপর যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচর-নির্যাতন ও ধর্মান্তরিত করার প্রবনতা বৃদ্ধি পায় তখন নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কুঞ্জু বিহারী সাধু ও তার পরিবার এপ্রিল মাসের দিকে পাড়ি জমান ভারতে। স্মরণার্থী হিসাবে তখন তারা আশ্রয় নেন ভারতে।
এদিকে কপিলমুনি ও তার আশপাশ এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের মিলিশিয়া বাহিনী ও রাজাকাররা তাদের ঘাঁটি হিসাবে দখল করে রায় সাহেবদের সু-উচ্চ ও সু-প্রশস্থ দেওয়াল বিশিষ্ট বসতবাড়ীটি। রাজাকাররা এ বাড়িটি অন্যতম ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে কপিলমুনি ও আশপাশ এলাকায় তাদের কর্মকান্ড। প্রায় ২০০ জন রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থান নেয় ঘাঁটিতে। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এলাকার সাধারণ মানুষ। অন্যের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী জোর পূর্বক আনা, তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
হিন্দুদের উপর অমানবিক অত্যাচার ও তাদের ধন-সম্পদ লুটসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল রাজাকাররা। রাজাকাররা জোর পূর্বক মনি সিং, জ্ঞান সিং, নরেন সিং, কানু পোদ্দার, তারাপদ ডাক্তার, জিতেন্দ্রনাথ সিং, শান্তিরাম সাধু সহ অসংখ্য হিন্দুকে তাদের নিজস্ব ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হতে বাধ্য করে।
অত্যাচার ও নির্যাতনের ঘাঁটি হিসাবে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পটি পরিচিতি লাভ করে। রাজাকারের এ ঘাঁটিটি ধ্বংস করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কঠিন ছিল। ১১ জুলাই লেঃ আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ঘাঁটিতে আক্রমন চালায়। কিন্তু প্রথম আক্রমনটি ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তালা থানার নকশালদের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটির উপর যে আক্রমন হয় সেটিও ব্যর্থ হয়। এতে রাজাকারদের মনবল বেড়ে যায়। যার কারণে এলাকার স্থানীয় লোকজন রাজাকারদের ভয়ে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করতে ভয় পেতো।
এরপর চূড়ান্ত আক্রমনের জন্য পরিকল্পনা তৈরীতে অংশ নেন, রহমত উলাহ দাদু, স.ম. বাবর আলী, ইউনুছ আলী ইনু, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ ও গাজী রফিকুল ইসলাম। কামরুজ্জামান টুকুর পরামর্শে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সদর দপ্তরে বসে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প চূড়ান্ত আক্রমের সিদ্ধান্ত হয়। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সব কমান্ডার গণ রাড়ুলীতে মিলিত হন এবং ৪ ডিসেম্বর রাত ৩টায় রাজাকার ঘাঁটিতে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী পৃথক পৃথক ভাবে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে রাজাকার ঘাঁটি। ৫ ও ৬ ডিসেম্বরের পর রাজাকারদের তেজ কমে আসে।
৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী নতুন উদ্যামে যুদ্ধ শুরু করে। মাইকের মাধ্যমে রাজাকারদের আত্মসমর্পনের জন্য বলা হয়। ওদের সব পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তখন তারা স ম বাবর আলীর সাথে আলোচনা করার জন্য প্রস্তাব দেয়। বটিয়াঘাটার ওমর ফারুক কৌশলে বাবর আলী সেজে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। অবাস্তব শর্ত দিলে ব্যর্থ হয় আলোচনা। পুনরায় শুরু হয় প্রাণপণ যুদ্ধ। প্রায় ২ ঘন্টা প্রচন্ড গোলাগুলি হয়। এতে গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কাবু হয়ে পড়ে রাজাকাররা। এমন সময় কপিলমুনির আকাশে একটি জঙ্গি বিমান উড়তে দেখে ভিতু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে রাজাকাররা। শেষমেষ বিনা শর্তে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় রাজাকাররা। তারা দল বেঁধে হাত উঁচু করে আত্মসমর্পন করতে থাকে। কপিলমুনি হাইস্কুল মাঠে রাজাকারদের আত্মসমর্পন দেখতে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়।
মোট ১৫৫ জন রাজাকারকে বন্দি করে দড়ি দিয়ে বেঁধে কপিলমুনি হাইস্কুল মাঠে রাখা হয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা রাজাকারদের ইচ্ছেমত মারপিট করতে থাকে। স্থানীয় লোকজনের দাবির প্রেক্ষিতে শেখ কামরুজ্জামান টুকু, গাজী রহমত উলাহ দাদু, ইউনুছ আলী, স ম বাবর আলী, মোড়ল আব্দুস সালাম, শেখ আব্দুল কাইয়ুম সহ কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করা হয় গণ আদালত। গণআদালতে সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
আটক ১৫৫ জন রাজাকারের মধ্যে দুই জন পালিয়ে এবং দু’জনের বয়স কম হওয়ায় মুক্তি দেওয়া হয়। বাকী ১৫১ জন রাজাকারকে কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দির হাইস্কুলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গুলি করে গণ আদালতের রায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। গণ আদালতের এ রায় কার্যকর করার মধ্যদিয়ে পতন হয় রাজাকার ঘাঁটি, রাজাকার মুক্ত হয় কপিলমুনি।
ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে নিহত হন ২ জন, এরা হলেন- ফুলতলার আনোয়ার ও আশাশুনির গোয়ালডাঙ্গার আনসার আলী। আহত হন অনেকেই। যাদের মধ্যে, আগড়ঘাটার তোরাব আলী, গড়ইখালীর রুহুল আমিন, খড়িয়ার আব্দুল খালেক, খুলনার জহুরুল হক বড়খোকা অন্যতম।
১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে ভারতের স্মরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসেন কুঞ্জু বিহারী সাধুর পরিবার বর্গ। দেশে এসেই ফিরে পান তাদের বসতবাড়ী। বর্তমানে কুঞ্জু বিহারী সাধুর ৪ ছেলের মধ্যে বেঁচে আছেন একমাত্র তপন সাধু। মারা গেছেন ছেলে সাধন, সত্যেন ও তুষার কান্তি সাধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত বাড়িটি কুঞ্জু বিহারী সাধুর পরিবার সংস্কার করে বসবাস করছেন।
ছেলে তপন সাধু জানান, নিজেদের এ বাড়ীটি ফিরে পাবো এমন আশা ছিলনা। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই নিজেদের বাড়িটি ফিরে পেয়েছি, পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছি এটাই স্বাধীনতার সুফল।
এদিকে স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও ঐতিহাসিক কপিলমুনি যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান সমূহ সংরণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাড. স ম বাবর আলী জানান, দক্ষিণ খুলনার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাজাকার ঘাঁটি ছিল কপিলমুনি। এই ঘাঁটি পতনের পর পুরো দক্ষিণ খুলনা মুক্ত হয়। একবারে ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড দেশের আর কোথাও নাই বললেই চলে। এ জন্য কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের সামনে যেখানে রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হয় সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ওই স্থানটি সংরক্ষণ করা উচিত। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একসময় ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ এবং কপিলমুনি মুক্ত হওয়ার ইতিহাস ভুলে যাবে।
--মোঃ আব্দুল আজিজ, পাইকগাছা।