Tuesday, June 7, 2016

দেশের মানুষই ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য

গত বছরের এই দিনে (৭ জুন, ২০১৫) মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার অ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলী। আমার বাবা। কয়েক বছর ধরে তিনি দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগছিলেন, সবারই জানা ছিল তাঁর পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারপরও বাস্তবতা মেনে নেওয়া কষ্টকর।

প্রচণ্ড পরিশ্রমী, আত্মপ্রত্যয়ী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন আমার বাবা শেখ রাজ্জাক আলী। তিনি ছিলেন একাধারে সফল আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষা অনুরাগী, সমাজসেবক এবং এর পাশাপাশি একজন স্নেহময় বাবা, দায়িত্বশীল ও মঙ্গলকামী এক মানুষ। স্ত্রী ও পাঁচ মেয়েসহ পরিবারের সবার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি। জাতীয় সংসদের তিনবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন তিনি (১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে)। পঞ্চম জাতীয় সংসদে (১৯৯১-৯৫) প্রথমে ডেপুটি স্পিকার ও পরে সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই পর্যন্ত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রশংসিত হয়েছেন একজন সুদক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে। ১৯৯০-এর দশকে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য পার্লামেন্টারিয়ান পত্রিকায় গণতন্ত্রচর্চা, সংসদ পরিচালনা ও সংবিধান সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালীন তিনি সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি মেনে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা করার ব্যাপারে সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। রাষ্ট্রীয় সংবিধান সমুন্নত রাখা ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব এবং এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। একপর্যায়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় পদ থেকে ইস্তফা দেন, যাতে তাঁর নিরপেক্ষতার বিষয়ে বিতর্ক না ওঠে। তবে তাঁর নিজের দলের অনেকের কাছেই ‘দলের স্পিকারের’ এতখানি নিরপেক্ষতা পছন্দ হয়নি। যার খেসারত স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী দিয়েছেন।

শেখ রাজ্জাক আলীর বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কিছুটা বিতর্ক যে ছিল না, তা নয়। তাঁর সঙ্গে বহুকাল যাঁরা রাজনীতি করেছেন, তাঁদের মনে কিছুটা আক্ষেপ ছিল, প্রশ্নও ছিল—কেন তিনি বামপন্থী রাজনীতি, ভাসানীপন্থী ‘ন্যাপ’ থেকে জাসদের রাজনীতিতে জড়িত হলেন? কেনই-বা ১৯৭৯ সালে নতুন সংগঠিত বিএনপিতে যোগ দিলেন? আবার কেনই-বা তিনি ২০০৬ সালে বিএনপি ছেড়ে এলডিপিতে যোগ দেন? এর পেছনের কারণগুলো বহুবার তাঁর মুখে শুনেছি। বামপন্থী দলের ‘অবাস্তব’ পরিকল্পনা ও অন্তঃকলহ তাঁর কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। তবে কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতা প্রায়ই তাঁর খুলনার ফারাজীপাড়া রোডের বাড়িতে যেতেন। এঁদের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহা, চট্টগ্রামের সুখেন্দু দস্তিদার, যশোরের কমরেড আবদুল হক, উত্তরবঙ্গের হাজী দানেশ, খুলনার রতন সেন ও শচীন বসুসহ অনেকেই ছিলেন। এর প্রধান কারণ তাঁর সহধর্মিণী ও আমার মা ভাষাসৈনিক, সমাজসেবক, শিক্ষক বেগম মাজেদা আলী ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

শেখ রাজ্জাক আলী বামপন্থী চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁর ভিন্নমত ছিল। তাঁদের আদর্শ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ নয়, বরং কোন পথে এগোনো সঠিক হবে, সেটা নিয়েই ছিল প্রশ্ন। জাসদের উগ্রবাদিতা ও সহিংসতায় বিশ্বাস করেননি, তাই তিনি ওই পন্থা মেনে নিতে পারেননি। বিএনপিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে দলের ভেতরের একনায়কতন্ত্রের ধারা, গঠনমূলক পদক্ষেপের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ, সুবিধাবাদী ভূমিকা ও যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার লোভ তাঁকে পীড়িত করত। এ পরিস্থিতিতে তিনি এই দলের সঙ্গে আর সংযুক্ত থাকতে চাননি। দেশ ও দেশের মানুষই ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য। যে কারণে কিছুটা হতাশা ও মনঃকষ্ট নিয়ে বলতেন, ‘আমার কালো গাউন আছে!’ মানে তাঁর একটি স্বাধীন ওকালতি পেশা আছে। রাজনীতি করে তাঁকে অর্থোপার্জন করতে হবে না। কারও পদলেহন করে রাজনীতি করার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না।

ছাত্র অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে ‘রেডক্রস’-এর সহযোগিতায় হাসনাবাদ ও বসিরহাটে শরণার্থী ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন। ১৯৭১ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে আমাদের খুলনার ফারাজীপাড়া রোডের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য হানা দিয়েছিল। এর আগেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। জুলাই মাসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়ার মতো বয়স তাঁর তখন ছিল না, কারণ বয়স তখন চল্লিশেও ওপরে। ভারতে সেবা দিয়েছেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের।

বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। প্রায়ই সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা সাংসদেরা ফোন করতেন তাঁকে কোনো সংসদীয় আইন বা কার্যপ্রণালিবিধির ব্যাখ্যা বা জটিলতা বুঝতে। তাঁর জীবনের প্রথম চাকরি ও পেশা ছিল সাংবাদিকতা, সে কারণে সাংবাদিকদের প্রতি ছিল বাড়তি দুর্বলতা। ১৯৫৩-৫৪ সময়কালে তিনি দ্য ডেইলি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় সাব-এডিটর পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ সালে চীন সফরে যাওয়ার পর সেখান থেকে ফিরে চীনে সমাজতন্ত্রের উত্থান সম্পর্কে ইতিবাচক কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন অবজারভার পত্রিকায়, যার কারণে তাঁর চাকরি চলে যায়। তখন তিনি খুলনায় গিয়ে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। তিনি অর্থনীতিতে এমএ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি তিনি ল পাস করেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি শখের বশে আর একটি এমএ করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে।

আইন পেশা ও রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার মধ্যেই তিনি নানা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। আইন পেশায় তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৮০-এর দশক থেকে তিনি হাইকোর্ট ও ১৯৯০-এর দশক থেকে সুপ্রিম কোর্টেই বেশির ভাগ সময় প্র্যাকটিস করেছেন।

১৯৬০-এর দশকে খুলনা ল কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সাবেক স্পিকার আবদুল হাকিম। শেখ রাজ্জাক আলী এই কলেজটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জড়িত। বেশ কয়েক বছর তিনি এর অধ্যক্ষ ছিলেন এবং ক্লাসও নিতেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে খুলনা শহরে তিনি ‘সুন্দরবন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন শহরের আরও কয়েকজন গণ্যমান্য, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সহযোগিতায়। পরবর্তী সময়ে সবরুন্নেছা ডিগ্রি মহিলা কলেজ, বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম টুটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মেয়েদের জন্য স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ২০০৭ সালের পর খুলনাতেই থাকা শুরু করেন শেখ রাজ্জাক আলী। তখন অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন বর্তমান খুলনার লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালটি নির্মাণের পেছনে।

শেখ রাজ্জাক আলী সম্পর্কে তাঁর সহধর্মিণী ও আমার মা বেগম মাজেদা আলীর উদ্যোগে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যে ব্যক্তি সারাক্ষণ নিষ্ঠার সঙ্গে ও শারীরিক সমস্যা উপেক্ষা করে একজন অভিভাবকের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালনা করতে পথনির্দেশনা দিয়েছেন, তাঁকে যেন আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি এবং এ দেশের ইতিহাসে তাঁর প্রাপ্য স্থানটুকু তাঁকে দিই, এ-ই আমাদের কামনা।

--রাণা রাজ্জাক: প্রয়াত স্পিকার অ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলীর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক।