উপকূলীয় এলাকা কয়রা উপজেলার সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ গ্রাম। সেখানকার মাদারস
কাবের এক সদস্যের বাড়িতে মাটির কলসীতে ট্যাব লাগিয়ে নিচে রাখা হয়েছে একটি
প্লাষ্টিকের বালতি। পার্শ্বেই সাবান কেস। বাথরুমের পর হাত ধোয়ার এ নতুন
কৌশলটি দেখে অনেকের মধ্যেই কৌতুহল জাগে।
অথচ ওই এলাকার অনেক মানুষই এক সময় বাথরুম থেকে এসে হাত ধুতে হয় এমনটি মনে করতে পারতেন না।
যে কারণে পেটের পীড়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ লেগেই থাকত। এখন তারা
স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশ সচেতন। তাই ওই বাড়ির ন্যায় অনেকেই এ ধরনের বিকল্প
ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন আঙিনায়। দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন
কর্মকান্ডে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও বেশ এগিয়ে। সম্প্রতি সরেজমিনে
পরিদর্শনকালে দেখা যায় এ ধরনের নানা সামাজিক কর্মকান্ডের প্রতিচ্ছবি।
আইলার পর কয়রা এখন ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সবচেয়ে
বেশী সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত একটি জনপদ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের
অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ জনপদ কয়রা। যেটি জলবায়ু পরিবর্তনে নিকট ভবিষ্যতে সবচেয়ে
বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন বাস্তবতায় সম্ভাব্য এই বিপদ বা ঝুঁকি মোকাবেলায়
সরকারি উদ্যোগে কয়রায় কোন উদ্যোগ-আয়োজন না থাকলেও কয়রার মানুষ এখন অনেক
সচেতন। নিজেদের সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে তারা অনেকটাই সোচ্চার।
উন্নয়ন সংগঠন রূপান্তরের উদ্যোগে এবং ওয়াটার এইডের সহায়তায় জলবায়ু
পরিবর্তনে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থাভ্যাস বিষয়ক এক প্রকল্পের আওতায়
কয়রার ৭টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে ছোট ছোট সংগঠন তৈরী করা হয়েছে বলেও জানা
যায়।
রূপান্তরের সূত্রটি জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি
ওয়ার্ডে ৩টি করে মোট ১৯০টি অনানুষ্ঠানিক কাবে এলাকার শিশু-কিশোর,
যুবক-যুবতি, মা, প্রতিবন্ধী, উপজাতিসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ স্বেচ্ছাসেবী
হিসেবে নিজ নিজ ওয়ার্ডের অন্যান্যদের মধ্যে জলবায়ু বিপদাপন্নতা বিষয়ে
সচেতনতার কাজ করছে।
প্রতিটি কাবে ৩০ জন হিসেবে মোট ৫,৭০০ জন
প্রশিতি সদস্য কয়রার পথে-প্রান্তরে স্বেচ্ছাশ্রমে নিরন্তন কাজ করে যাচ্ছে।
দ্বারে দ্বারে ঘুরে উঠান বৈঠক করে ৫,৭০০ জন নারী-পুরুষ সমাজে জলবায়ুর
নেতিবাচক প্রভাবের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নানাবিধ কর্মকান্ড-পরিচালনা করে
যাচ্ছে।
রূপান্তরের প্রকল্প সমন্বয়কারী রাবেয়া বসরী জানান, ১৯০টি
কাবের প্রতিটিই স্থানীয়ভাবে এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও দুর্যোগ
ঝুঁকি হ্রাস, সতর্ক সংকেত প্রচার, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, কুসংস্কার
দূরীকরণ, নারীর মতায়ন, নারী নির্যাতন, শিশু সুরা, বাল্য বিবাহসহ সমাজের
বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করছে। অল্প সময়ে কাবগুলো স্থানীয়ভাবে
শুভবুদ্ধি চর্চার এক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সহযোদ্ধা
হিসেবে এই কাবগুলো কয়রার প্রতিটি পরিবারে স্বাস্থাভ্যাস পরিবর্তন,
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সুপেয় পানির সংররণের বিভিন্ন উপায় নিয়েও
কাজ করে বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। দলবদ্ধ হলে, মতের ঐক্য
হলে শত প্রতিবন্ধকতাও যে হার মানে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কয়রার সাম্প্রতিক
এই পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কোন কাঠামোর পরিবর্তন নয়-এই পরিবর্তন চেতনার। এই
পরিবর্তন মননের। এই পরিবর্তন চিন্তার।
স্থানীয় সচেতন মানুষ জানান,
চিন্তা-চেতনার এই পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে কয়রার নেতিবাচক প্রভাবগুলোতে
ইতিবাচক সুরা দিতে শুরু করেছে। তৃণমূল জনগোষ্ঠীর নিবিড় এই অংশগ্রহণে একটি
নিরব বিপ্লব যেন ঘটছে এখানকার সমাজ ব্যবস্থায়-আর্থসামাজিক অবকাঠামোয়।
মদিনাবাদ গ্রামের মাদারস কাবের সভানেত্রী শিপ্রা রায় বলেন, তাদের কাবের
সদস্যদের নিয়ে তারা দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় ছাড়াও স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসে
বিভিন্ন কর্মকার্তা, টিউবওয়েলের গোড়া উঁচু করা, বাল্যবিয়ে ও যৌতুকবিরোধী
সচেতনতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড করছেন। দুর্যোগের পূর্বাভাসে তারা
সম্পদের মায়া ত্যাগ করে আগে প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী নারী এবং শিশু-বৃদ্ধদের
সাইকোন শেল্টার বা উঁচু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় আশ্রয় নেয়ারও সহায়তা করেন।
আইলার পর তাদের এলাকার পুরুষরাও অনেকটা সচেতন বলে তারা উল্লেখ করেন।
এ সময় কথা হয়, কাবের সাধারণ সম্পাদিকা তুলসী সরদার, সদস্য সরদা বিশ্বাস,
নিলঞ্জনা মজুমদার, কল্পনা রায়, রোকসানা পারভীনসহ অনেকের সাথে। তারা জানান,
ওই এলাকার স্বামীরা এখন আর বউ পেটায় না।