Tuesday, December 5, 2017

স্মৃতিপটে বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মন্ডল (১ম পর্ব)

স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ একজন গুরুদাসী


আমার স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বসে গেছে! হ্যা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক অনন্য স্মৃতিস্তম্ভকে আমরা হারিয়েছি। হারিয়েছি গুরুদাসীকে- স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ গুরুদাসী মন্ডল'কে। আর দেখা হবে না তার সাথে। 'কনে ছিলিরে' বা 'কনে আছলি' বলে অট্টহাসি দেবে না, ডুঁকরে ডুঁকরে কাঁদবেও না আর কোন দিন। 'দাঁড়া' বলে পরম মমতায় উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকবে না- আমার মা, আমার বোন, আমার মেয়ে গুরুদাসী! গুরুদাসী মরে গেছেন!! 


গুরুদাসীর বাড়ি পইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ফুলবাড়ি গ্রামে। স্বামীর নাম গুরপদ মন্ডল। স্বামী পেশায় ছিলেন দর্জি। দর্জি হলেও সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। স্বাধীনতাকামী অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন তিনি। ২ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছিল তাদের সুখের সংসার।

রাজাকারদের ইন্ধনে পাকসেনারা তার বাড়িতে হামলা চালায়। একে একে পরিবারের সব সদস্যকে বাড়ির উঠানে জড়ো করা হয়। গুরুপদ মন্ডলের স্ত্রী গুরুদাসী মন্ডলের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পাক সেনাদের। নিজ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে এগিয়ে এলে গুরুদাসীর সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তার স্বামী, ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃতদেহ বীভৎস করে দেয়া হয়। এরপর গুরুদাসীর কোলে থাকা দুধের শিশুকে মাতৃক্রোড় থেকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। মায়ের সামনেই তাকে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পাশে কাঁদা পানির ভেতরে। তারপর গুরুদাসীর ওপর হায়েনারা পাশবিক নির্যাতন শুরু করে।

পাক হানাদার সেনারা চলে গেলে, মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী গুরুদাসীকে উদ্ধার করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন উদ্ধার করেন, গুরুদাসী তখন জীবন্মৃত। তার দেহের খোলসটাই ছিলো শুধু। নিজ চোখের সামনে স্বামী, ছেলে-মেয়ের মৃত্যু এবং পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে গুরুদাসী পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধারা গুরুদাসীকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজাতে রাখেন।

দেশ স্বাধীনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। মানসিক ভারসাম্যহীন গুরুদাসী দেশের বিভিন্ন জায়গায় উদবাস্তের মতো ঘুরে এক সময় ফিরে আসেন স্বামী-সন্তানের স্মৃতি বিজড়িত পাইকগাছায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের পরিবার ও স্বজনদের হারিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে তিনি তার চারপাশকে আপন করে নেন।

পাইকগাছা কপিলমুনির রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন গুরুদাসী মন্ডল। প্রতিবেশীর দরিদ্র সন্তানকে তিনি অতি স্নেহে বড় করছেন। মাঝে মাঝে খুলনা শহরের পিকচার প্যালেস, কেডি ঘোষ রোড এলাকায় নিঃস্ব এই বীরাঙ্গনা পথে পথে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন।

তার এলাকায় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন গুরদাসী। তিনি উপকথার নায়িকার মতো সবার একান্ত আপন। সব হারিয়েছেন যে দেশের জন্য, সেই দেশ গুরুদাসীকে কিছুই দিতে পারেনি। অবশ্য যে সব রাজাকার নির্যাতন করেছিল, তারা সবাই বহাল তবিয়তে আছে। ইতিহাসের নিষ্ঠুর প্রহসন! এখনও সেই রাজাকাররা প্রতারিত করে চলছে দেশের মানুষকে।

স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালেরে ডিসেম্বর মাসে তার অন্তিম যাত্রা হয়তো আমাদের নিস্প্রভ নিস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ অভিমান, হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে রাজাকারের উত্থানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ!

গুরুদাসী, তুমি ৭১ থেকে আজ এবং অনন্তকাল বাংলার স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে বেঁচে ছিলে, স্মৃতিস্তম্ভ হয়েই বেঁচে থাকবে!

বঙ্গজননীর বুকে চিতার ভস্ম গুরুদাসী, তোমায় অভিবাদন, সালাম, নমস্কার
!