সুন্দরবন থেকে অপরিকল্পিতভাবে মধু ও মোম আহরণ করায় মৌমাছির বংশ বিস্তার
ব্যাহত ও মধু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বছরের পর বছর মৌয়ালরা সুন্দরবনে সনাতন
পদ্ধতিতে মধু ও মোম আহরণ করে আসছেন। সনাতন
পদ্ধতিতে মধু আহরণের ফলে লাখ লাখ মৌমাছি আগুনে পুড়ে মারা যায়। ফলে মৌমাছির
বংশ বিস্তার ব্যাহত হওয়ায় মধু ও মোম উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে
মধু ও মোম সংগ্রহের প্রবণতা বন্ধ না হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে
যাবে। পাশাপাশি সরকার এ খাত থেকে বিপুল পরিমান রাজস্ব বঞ্চিত হবে।

পৃথিবীর একক বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’ বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের
৪৪ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত। এ বনের প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
অপরূপ সৌন্দর্যের শত শত প্রজাতির ফুলফলে ভরা সুন্দরবন প্রাণ বৈচিত্রে
সমৃদ্ধ। ঋতুচক্রে বসন্তের আগমনে বনে নানা ফুলে ভরে যায়। বাতাসে ফুলের মৌ মৌ
সুগন্ধ। এ সময় নানা প্রজাতির পাহাড়ি মৌমাছিরও আগমন ঘটে। মৌমাছি ফুলে ফুলে
মধু আহরণ ও মৌচাক তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। সুন্দরবনের সুমিষ্ট
মধু মহা ঔষধ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। বাণিজ্যিকভাবে এ মধু দেশের চাহিদা মিটিয়ে
প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে মৌয়ালরা মধু
আহরণ করতে গিয়ে বাঘ, সাপ, কুমিরের সাথে জীবন বাজী রেখে বন দস্যুদের চাঁদা ও
পাশ-পারমিটে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি মৌয়ালদের অসচেতনভাবে
মধু আহরণের ফলে তাদের ফেলে রাখা আগুনে বনে আগুন লাগার আশংকা থেকে যায়।
যথেচ্ছা ব্যবহারে ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের আধার সন্দুরবনের জীববৈচিত্র্য
হুমকি সম্মুখীন।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন
পর্যন্ত মধু আহরণ মৌসুম। এ সময় বন বিভাগের বিভিন্ন স্টেশন থেকে পাশ-পারমিট
নিয়ে মৌয়ালরা বনে যায়। এ ব্যাপারে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগীয় কর্মকর্তা
জহিরউদ্দীন আহম্মেদ জানান, প্রতি মাসে ২ বার করে মৌয়ালীদের পাশ পারমিট
দেওয়া হচ্ছে। জুনের ৩০ তারিখ পর্যন্ত মধু আহরণ চলবে। খুলনা বন বিভাগ থেকে ৩
হাজার মণ মধু ও ৮শ মণ মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করতে প্রতি মণ মধুর জন্য ২শ টাকা ও প্রতি মণ
মোমের জন্য ৩ শ টাকা করে বন বিভাগকে রাজস্ব দিতে হয়।
তবে
নির্ধারিত সময়ের আগে কিছু চোরা মৌয়াল বন বিভাগের কর্মচারিদের সহযোগিতায় বন
থেকে অপরিকল্পিতভাবে মৌচাক কেটে মৌমাছির প্রজননে বাধা সৃষ্টি করে। মধু ও
মৌচাক নষ্ট করে মধু উৎপাদনে ব্যঘাত ঘটায়।
খুলনা বাগেরহাট,
সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকার ১৯/২০টি উপজেলার মৌয়াল পরিবারগুলো জীবন
জীবিকার তাগিতে বনে মধু সংগ্রহ করে থাকে। মৌয়ালরা মহাজনের অধীনে প্রতি
নৌকায় ৯/১০ জন করে বনে প্রবেশ করে। মৌচাক খুঁজে বের করার জন্য ১জন মৌয়াল
থেকে বাকী মৌয়ালরা সারিবদ্ধ হয়ে আগে পিছে সতর্ক দৃষ্টি রেখে মৌচাক খুজতে
থাকে। একটি মৌয়াল মৌচাক দেখতে পেয়ে সংকেত দিয়ে বাকিদের জানায়।
পাইকগাছার মৌয়াল বারিক জানান, একটি মৌমাছি শত শত ফুল থেকে মধু পান করে
মৌচাকের ছোট কুটুরে মধু ঢালে। মৌমাছির উড়ে যাওয়া গতিবিধি দেখে মৌয়ালরা
মৌচাক সন্ধান করে। মৌয়ালদের বাঘ, সাপ, কুমিরের সাথে জীবন বাজী রেখে মধু ও
মোম সংগ্রহ করতে হয়। নৌকায় জনপ্রতি বন্যদস্যুদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না
দিলে মারপিট ও অপহরণের শিকার হতে হয়।
মৌয়ালরা সেকেলে পদ্ধতিতে
মৌচাক থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করে। তারা মৌচাকে আগুন ও ধোয়া দিতে মৌমাছি
সরিয়ে মৌচাক কাচি, দা দিয়ে কেটে আনে। এসময় আগুনে মধু ও মোম নষ্টসহ মৌচাকের
হাজার হাজার মৌমাছি আগুনে পুড়ে মার যায়। এতে মৌমাছি প্রজনন ও বংশবৃদ্ধিতে
বাধাগ্রস্ত হয়। মৌচাক আগুনে পুড়ে মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়। তাছাড়া অপরিষ্কার ও
অপরিচ্ছন্নভাবে পোকা ও ডিমসহ মৌচাক চেপে মধু আহরণ করায় মধুর গুণগত মান নষ্ট
হয়।
মধু দেশের চাহিদা পূরণ করে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা
অর্জনের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। প্রাকৃতির এ সম্পদ, মধু আহরণে সময় মধু ও মোম
নষ্ট না হয়, বাচ্চা ও মৌমাছি আগুনে পুড়ে না মারা যায় তার জন্য মধু অহরণের
মৌসুমের আগে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাক কাটার পদ্ধতি মৌয়ালদের শেখানো দরকার।
এজন্য মৌয়াল পাশ পারমিট নিয়ে যাওয়ার আগে মধু আহরণে আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও
প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। মধু আহরণে প্রতি বছর অগুনে পুড়ে লক্ষ লক্ষ মৌমাছির ডিম
ও বাচ্চা পুড়ে মারা যাচ্ছে। এতে মৌমাছির প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে। তাই মৌয়ালদের প্রশিক্ষণসহ সচেতনতা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেছেন
বন বিশেষজ্ঞরা।