Wednesday, December 11, 2013

একাত্তরে ওরা আমার নানাকে খুন করেছিল

‘রাজাকার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ এখন অর্থহীন। জাতীয় জীবনে সবচেয়ে ঘৃণ্য শব্দগুলোর মধ্যে এটি এখন একটি। আমার পারিবারিক জীবনে এই কুশব্দের ওজন আর বিষাক্ততা অনেক বেশি। কারণ, আমার মা মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতৃহারা হয়েছিলেন এই শ্রেণীর কিছু অমানুষের কারণে। মায়ের ছোট ভাই-বোনেরা (টিপু মামা. মুক্ত মামা, সাথী খালা) তখনও শিশু; আর আমার সবচে’ ছোট খালা (সাবিনা ইয়াসমীন মালা) তখন ছিলেন মাতৃগর্ভে; বাবা কী, তা তাঁরা জানতেও পারেননি কোনদিন।

শেখ মাহতাব উদ্দীন (মনি) খুলনার পাইকগাছা উপজেলার তৎকালীন গদাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৭১-এ। ‘মনি চেয়ারম্যান’ হিসেবে এক নামে তাঁকে চিনতেন পাইকগাছার সবাই। শিক্ষিত ও মানবদরদী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল কয়েক যুগ ধরে। প্রায় ১২ বছর ধরে সুনামের সাথে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সেই মনি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই শেখ বেলাল উদ্দীন (বিলু) এবং বড় ছেলে শেখ শাহাদাত হোসেন (বাচ্চু) এপ্রিল-এর শেষ দিকে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তখন থেকেই স্থানীয় রাজাকারদের চক্ষুশূল মনি চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবার। আমার বড় মামা (বাচ্চু) ছিলেন দাকোপে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার। গেরিলা অপারেশন করেছেন দক্ষিণ খুলনায়।

এদিকে পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছিল নানার রাজনৈতিক ও পারিবারিক প্রতিপক্ষ ও তার সাঙ্গপাঙ্গ। পাকিস্তানী সেনাসদস্যদেরকে খাবার, আশ্রয় আর আমোদ-প্রমোদের যোগান দিত তারা। আমার মামা মুক্তিযোদ্ধা জেনেও তারা নানাকে প্রস্তাব দেয় শান্তি কমিটির সদস্য হতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে। স্বভাবত:ই নানা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

২৮ জুলাই, ১৯৭১। গভীর রাতে নানাকে খুঁজতে তাঁর ২য় বাড়িতে (যেখানে তার গর্ভবতী দ্বিতীয়া স্ত্রীকে নিয়ে তিনি তখন ছিলেন) এলো কয়েকজন লোক, একজনকে তিনি চিনতেন (নাম তার মশিউর)। মশিউররা বলল, বড়মামা তাঁর সাথে দেখা করার জন্যে নদীর পাড়ে লুকিয়ে আছেন। যাঁর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, তিনিও কম সাহসী নন। এদের হাতে বেয়নেট দেখে নানা হয়ত কিছু বুঝতেও পেরেছিলেন। তাই হয়ত শেষ দেখা করতে এসেছিলেন আমার নানী (তাঁর প্রথমা স্ত্রী)-র সাথে তাঁর মূল বাড়িতে। নানা বলেছিলেন, তিনি বড়মামা-র সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাই নানী তার হাতের বালা খুলে মশিউরকে দিলেন, সাথে কিছু টাকা আর খাবার। নানাকে একা ছাড়তে ভয় করছিল নানীর। তবু নানীর নিষেধ আর সাবধানবাণী উপেক্ষা করে নানা সেই অস্ত্রধারী লোকদের সাথে চললেন ছেলের সাথে দেখা করতে।

কিন্তু গিয়ে দেখেন, ছেলে নয়, তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে তাঁর শত্রুপক্ষ। সেখানে ‘জয় বাংলা’-র পক্ষের আরো কয়েকজন স্থানীয় ভাল মানুষ। তাঁদেরকে চোখ আর হাত বেঁধে সারি করে নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড় করানো হলো। তারপর গুলি। গুলির শব্দ শুনে হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নানা। সেই ডুবন্ত মানুষটাকেও গুলি করল আমিন গাজীর ভাস্তে দাউদ গাজী। গুলির আঘাতে নদীর জল থেকে লাফিয়ে ওঠেন নানা “আল্লাহু আকবর” বলে। রাজাকাররা মানুষের রূপে পিশাচ, আর তাইতো বৃদ্ধ মানুষটাকে নদীর জলে গুলি খেয়ে ডুবতে দেখেও ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তাঁর রোগা শরীর।

(এ সব বর্ণনা পরে তাঁর পরিবারের কাছে করেছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী; যিনি নদীর পাড়ের এক গাছে উঠে পুরো ঘটনাটি দেখেছিলেন নীরবে; নানাকে বাঁচাবার দু:সাহস তিনি দেখাতে পারেননি)।

নানার মৃতদেহ পরদিন ভোরে পাওয়া যায়। আমার মা সেই গুলিবিদ্ধ, ঝাঁঝরা বিভৎস লাশ দেখে শোকে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে যান। গুলি লেগে উড়ে গিয়েছিল নানার একটা চোখ। সেই চোখহীন কোটরে তুলা ভরা ছিল। মার মুখে কথা ফুটেছিল কয়েক ঘণ্টাপর। নানী হয়ে গিয়েছিলেন পাথর। বড় মামা তখন দেরাদুনে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প-এ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বাবার লাশ একবার দেখতেও পাননি তিনি। বড় মামা তাঁর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেননি। বরং স্বাধীনতার পর তাঁর বাহিনীর কাছে ১০৮টি রাইফেলসহ স্থানীয় রাজাকারবাহিনী আত্মসমর্পন করলে তিনি তাদের ছেড়ে দেন। তাঁর এই মানবতা আমাকে এখনও অবাক করে !

১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ স্বাধীন হয়েছিল খুলনা। এই ৪১ বছরে কোন শাস্তিই হয়নি ওই খুনীদের। বরং অন্য অনেক রাজাকারের মতো সে এবং তার সঙ্গীরা এদেশের সব নাগরিক সুবিধা ভোগ করেছে, রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে, নির্বাচিতও হয়েছে। সেই খুনীরা এখন বেঁচে নেই, তবে তাদের বংশধরেরা ঠিকাদারি আর রাজনীতি করে দিব্যি আছে এখনও।

আমাদের এই প্রজন্মটি বড় হয়েছে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে, যার একটি অংশ সঠিক ইতিহাস জানেনা; অন্য অংশটি বেঁচে আছে এক অদ্ভুত বিষ আর বিস্ময় বুকে নিয়ে…। আর সবচেয়ে বড় বিস্ময়, সেই খুনীদের মুক্তির প্রকাশ্য দাবী জানায় তাদের সঙ্গী ও শিষ্যরা; এটা নাকি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ! ওদেরকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ নামে অভিহিত করে ‘জাতে তুলতে’ নারাজ আমি; ওরা খুনী, ওরা ধর্ষক, ওরা দেশ ও মানবতার শত্রু।

কৃতজ্ঞতা: কাজী মনজুর