Saturday, September 20, 2014

সুন্দরবন উপকুলবাসীর রক্ষাকবচ

মানুষের জন্মের আগে বনের সৃষ্টি। মানুষ তার প্রয়োজনে বন ধ্বংস করছে। আর বন মানুষ, লোকালয় ও পরিবেশ রক্ষা করে চলেছে। মানুষের আগ্রাসনে বন সংকুচিত হচ্ছে। মানুষের নির্বিচারে নিধনের ফলে বন দুরে সরে যাচ্ছে। সুন্দরবন প্রকৃতির সৃষ্টি। এ বন সৃষ্টিতে মানুষের কোন হাত নেই। সুন্দরবন প্রকৃতির বিষ্ময়। 

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন শুধু প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়। সুন্দরবন উপকূলীয় জনপদকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস থেকে মাতৃস্নেহের বুকে আগলে রেখে প্রকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে লোনা পানিতে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।

বাংলাদেশ ও ভারতের প্রাকৃতিক স্বর্গ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জোয়ার ভাটার ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ বনের মোট আয়তন ১০২৮০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ ভারতের পশ্চিবঙ্গে অবস্থিত। ২০০ বছর আগে এ বনের আয়তন ছিল প্রায় ১৬৭০০ বর্গকিলোমিটার। মানুষের অগ্রাসনে বন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

সুন্দরবনের নামের উৎপত্তি সন্বন্ধে একাধিক মত থাকলেও সুন্দরী নামের বৃক্ষ থেকে এ বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। এ বনের ভিতর দিয়ে উত্তর/দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে ছোট বড় ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল। ২০০৪ সালের বাঘ শুমারী অনুযায়ী রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে ৪৪০টি। শক্তি সাহস আর আকৃতি প্রকৃতিক বিবেচনায় স্নুদরবনের বাঘ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজাতির জন্তু। নয়নানিভরাম সৌন্দর্যের প্রাণী হরিণের সংখ্যা ১ লক্ষ হবে বলে ধারণা করা যায়। চিতল হরিণ সৌন্দর্যের বিচারে জগৎ বিখ্যাত।

৭১’র মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবন অপরাজেয়, হার মানেনি। ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর প্রলংকারী ঝড়ে সুন্দরবন ক্ষত বিক্ষত হয়ে উপকুল এলাকা রক্ষা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে হতক্লান্ত। তবুও হার মানেনি। উপকূলবাসীর রক্ষা কবচ ও সুন্দরবনের স্বাধীনতা যুদ্ধে রয়েছে গৌরবময় ভুমিকা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের কেন্দ্র হয়ে উঠে দুর্গম সুন্দরবন।

তাছাড়া এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে সুন্দরবনে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ ও যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তুত করত। মুক্তিযোদ্ধাদের সুন্দরবন মায়ের মত আগলে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধে ৯নং সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় ও ট্রেনিং স্থল হয়ে উঠে এ বন। মেজর জিয়া উদ্দীনের (তৎকালীন লেঃ) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা বাগেরহাট পিরোজপুর এলাকার পাক বাহিনী ও তাদের দোষর দালাল, রাজাকারদের, নাভীশ্বাস বের করেছে। নৌকমান্ড লেঃ কমান্ডার রহমাতুল্লাহ দাদুর নেতৃত্বে নৌ সেনা ও ডুবুরিরা চালনা, মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার অবস্থানরত পাকসেনা ও তাদের দোসরদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে।

মুল্যবান প্রানীজ, জলজ ও বনজ সম্পদ মিলিয়ে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আঁধার এ সুন্দরবন। শুধু জীব বৈচিত্রের উৎস নয়, একই সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবন উপকুলীয় এলাকায় প্রায় ১২ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকার উৎস হিসেবে অবদান রাখছে। বনজ সম্পদ আহরণে ৫/৬ লক্ষ মানুষ প্রায় ৬ মাস জীবিকার জন্য সরাসরি সুন্দরবনের উ্পর নির্ভরশীল।

সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছাস, ঘুর্ণিঝড় থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলকে নিরাপদ রেখে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন দক্ষিণ জনপদের প্রকৃতিক ঢাল হয়ে ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছাস থেকে বুক পেতে আগলে রাখে। জীব বৈচিত্র্যের আধার আমাদের সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।