Saturday, December 9, 2017

আজ ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস

জনতার রায়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদণ্ডের দিন


আজ ৯ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস। পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি ইউনিয়নবাসীর জন্য এক গৌরবময় আনন্দের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে কপিলমুনির মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা পাকহানাদের পরাজিত করে এলাকাটি শত্রুমুক্ত করে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ও মার্তৃভুমির টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার অকুতভয় দামাল ছেলেরা।


এই মাঠেই ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর কারা হয়
যুদ্ধকালীন সময়ে ও তার পুর্বে পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি'সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ এবং শান্তি কমিটির দালালরা লুটপাট থেকে শুরু করে ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় নিরীহ মানুষের উপর। 


সেদিনের লোমহর্ষক ও বর্বোরোচিত ঘটনার কথা আজও ভুলিনি এলাকার মানুষ। ভয়ংকর রাতের স্মৃতি আর হানাদার বাহিনীর তান্ডবলীলা এখনও প্রবীনদেরকে শিউরে তোলে। উপজেলা সদর হতে ১২ কিঃমিঃ উত্তরে কপোতাক্ষের তীরবর্তী ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনির অবস্থিত। প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু। সে সময় রায় সাহেবের বিশালাকৃতির বাড়ীটি রাজাকাররা সুরক্ষিত দুর্গ হিসাবে বেঁছে নিয়েছিল। মান্দাতা আমলের ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটিকে ঘিরে যুদ্ধের অনেক স্মৃতিচিহ্ন আজও বহন করে চলেছে।

রাজাকাররা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রাচীর বেষ্টিত দ্বিতল এ ভবনটি তাদের ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত মনে করে গড়ে তুলেছিল রাজাকার ঘাঁটি। প্রায় ২০০ জন রাজাকার সর্বদা নিয়োজিত থেকে যুদ্ধ করেছিল। এলাকার হিন্দু ও নিরীহ লোকদের ধরে এনে নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে আজও শিহরিত হন প্রবীনরা।

১৯৭১ সালে ১১ জুলাই লেঃ আরিফিনের নের্তৃত্বে সরদার ফারুক আহমেদ, আবুবক্কার, শাহজাহান, মাহতাব, লতিফ, আনোয়ার, মনোরঞ্জনসহ আরোও অনেকে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন চালায়। রাত ৩টা থেকে পরদিন বেলা ৩টা পর্যন্ত চলে একটানা যুদ্ধ।

ঐ সময় খাদ্য, পানীয় ও স্থানীয় লোকজনের সহযোগীতার অভাবে প্রথমবারের অভিযানে রাজাকার ঘাটির পতন ঘটানো সম্ভব হয়নি। এরপর সমন্বিত মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যমতে শুরু হয় নতুন পরিকল্পনা। আর এরই মধ্যে রাজাকারদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। কথিত আছে, কপিলমুনি বাজারের কৃষ্ণচুড়া বৃক্ষের নীচে জবাই করে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো নিরীহদেরকে। 

রায় সাহেবের বিশালাকৃতির বাড়ীটি রাজাকাররা সুরক্ষিত দুর্গ হিসাবে বেঁছে নিয়েছিল
এদিকে যুদ্ধের নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনীর দক্ষিণ খুলনার সমস্ত ক্যাম্প কমান্ডারদের একত্রিত করে তাদের মতামত ও যুদ্ধের কলাকৌশল নির্ধারণ করে পুনরায় শুরু হয় যুদ্ধ। ঐ সময় চুড়ান্ত পরিকল্পনায় অংশ নেন গাজী রহমত উল্লাহ দাদু, স. ম. বাবর আলী, ইউনুচ আলী, শাহাদাৎ হোসেন বাচ্ছু, আঃ সালাম মোড়ল, আবুল কালাম আজাদসহ আরোও অনেকে।

৬ ডিসেম্বর রাতে আক্রমণ করা হয় কপিলমুনি রাজাকার ঘাটি। দফায় দফায় চলে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ। স্থানীয় প্রতাপকাটি কাঠের ব্রীজের উপর ৮ জন রাজাকার, তার একটু পেছনে আরো ৫ জন রাজাকার যুদ্ধে মারা যায়। একেরপর এক মরতে থাকে পাক দোসর রাজাকারদলের সদস্যরা। ৭ ও ৮ ডিসেম্বর একটানা যুদ্ধের পর ৯ ডিসেম্বর সকাল ১১ ঘটিকায় ১৫৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। 


রাজাকারদের পতন ও কপিলমুনি হাইস্কুল মাঠে আত্মসমর্পন এর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে চতুর্দিক থেকে জড়ো হতে থাকে জনতা। উপস্থিত জনতার সমন্বয়ে একটি গন আদালত গঠন করে ১৫৫ জন রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। কপিলমুনি সহচরী বিদ্যামন্দিরের মাঠে দুপুর ২টায় প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কারার মধ্যদিয়ে মুক্ত হয় পাইকগাছার কপিলমুনি।

উল্লেখ্য, কপিলমুনি মুক্ত দিবসের সঠিক তারিখ ৭ ডিসেম্বর না ৯ ডিসেম্বর এই বির্তক রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এক অংশ এতদিন বলেছে ৭ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস। জানা যায়, ১৯৯২ সালে কপিলমুনি মক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী সহ-অধিনায়ক প্রয়াত মোড়ল আব্দুস সালাম প্রথম এই মুক্ত দিবস পালনের উদ্যোগ নেন এবং ৭ ডিসেম্বর সাড়ম্বরে পালিত হয় ঐতিহাসিক কপিলমুনি মুক্ত দিবস। 

এই মাঠেই জনতার রায়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ১৫১ রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর কারা হয়

পরবর্তীতে কপিলমুনি মুক্ত দিবসের তারিখ নিয়ে তৎকালীন পাইকগাছা থানা আ‘লীগের সাধারন সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত এ্যাড. স,ম ইউসুফ আলী পত্রিকায় বিবৃতি দেন কপিলমুনির মুক্ত দিবসের সঠিক তারিখ ৯ ডিসেম্বর। ফলে বির্তকের সৃষ্টি হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। ফলে দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। স্ব স্ব কর্র্মসূচি নিয়ে ৭ ও ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস পালিত হয় কয়েকবার।

ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী এক পক্ষের দাবী ছিল, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর শনিবার রাত ৩ ঘটিকায় অতর্কিতে কপিলমুনি রাজাকারদের এই শক্ত ঘাটিতে আক্রমণ শুরু হয়। ৫ ও ৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ চলে। ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজাকাররা আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।

তবে মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম জানান, মুক্ত দিবসের তারিখ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এতদিন যে বিরোধ ছিল তার অবসান ঘটেছে। সবাই বসে তারিখ ঠিক করেছেন ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস।