Sunday, September 22, 2013

হরিণ কেনা-বেচার গোপন হাট !

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ``বাঘের লাফ কুড়ি হাত, হরিণের লাফ একুশ।`` অর্থাৎ লাফিয়েই বাঘ মামার থাবা থেকে নিস্তার মেলে হরিণের। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাঘের থাবা থেকে মাঝে মধ্যে রক্ষা পেলেও শিকারিদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সুন্দরবনের মায়াবী চিত্রল হরিণ।

বনদস্যু ছাড়াও অবৈধ শিকারি ও কাঠ পাচারকারী চক্র এখন বেপরোয়া সুন্দরবনে। বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, বিষ টোপ এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে হরিণ শিকারে।

বনসংলগ্ন এলাকার লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরিণ শিকারি পেশাদার ব্যবসায়ী ও বিশেষ সিন্ডিকেট। আর এসব ব্যবসায়ীরা পেশাদার শিকারিদের অগ্রিম দাদন দিয়ে নানা কৌশলে মাংস এনে বিক্রি করছে লোকালয়ে।

আর বনসংলগ্ন বেশ কিছু গ্রামে নিয়মিত বসছে হরিণের মাংস বেচাকেনার গোপন হাট। দামটাও বেশ কম। কেজি প্রতি ৩/৪শ’ টাকায় এসব হাটে মিলবে হরিণের মাংস।

সুন্দরবন সংলগ্ন মংলা উপজেলার জয়মনী, চিলা, বাঁশতলা, বৌদ্ধমারী, বাণীশান্তা মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঝিউধরা, গুলিশাখালী, সন্ন্যাসী, শরণখোল উপজেলার আমড়াতলা, ধানসাগর, তাফালবাড়ী, চালিতাবুনিয়া, বগি খুলনার দাকোপের ঢাংমারী, খাজুরা প্রভৃতি এলাকায় সুযোগ বুঝে শিকারিরা অনেকটা প্রকাশ্যেই হরিণের মাংস বিক্রি করে থাকে।

সূত্র মতে, মাংস, চামড়া ও শিংয়ের ব্যাপক চাহিদার কারণেই পেশাদার শিকারিরা হরিণ নিধনে মেতে ওঠে। এছাড়া এক শ্রেণীর ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নিতান্তই শখের বশে হরিণ শিকার করে থাকেন।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতেও তদবির/উপটোকন হিসেবে হরিণের মাংস সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। হরিণ শিকারিরা একটি মাঝারি আকৃতির হরিণ শিকার করেই তা কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারে।

অনুসন্ধানে জানান যায়, বন সংলগ্ন এলাকার অভাবী ও গরিব লোক অনেকেই দারিদ্রের কারণে হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। এছাড়া লোকালয়ের অনেক লোক শখের বশেও হরিণ শিকার করে থাকে।

বনসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র মতে, সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার হয় ঈদ, পূজা ও সুন্দরবনের রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একজন সাবেক জন প্রতিনিধি জানান, আগের তুলনায় হরিণ শিকার ও প্রকশ্যে বিক্রি এখন অনেক কমেছে। তবে সামনে কোররানি ঈদ ও পূজার মৌসুমে বাড়তে পারে হরিণ শিকার। কারণ এসময় চাহিদা বেশি থাকায় শিকারিরা বেশি দাম পায়।

তিনি জানান, এসব মৌসুমে এক কেজি হরিণের মাংস হাজার ১২শ’ টাকায়ও বিক্রি হয়।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শিকারি চক্রের সদস্যরা মাছধরা জেলেদের ছদ্মবেশে বনের গহীনে গিয়ে হরিণ শিকার করে তা গোপনে লোকালয়ে নিয়ে আসে। পরে শিকার করা হরিণ কৌশলে লোকালয় থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। এজন্য সংঘবদ্ধ শিকারি চক্রের লোকালয়ে নির্দিষ্ট এজেন্ট নিয়োজিত রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে ৩/৪শ’ টাকা করে কেজি দরে হরিণের মাংস সংগ্রহ করা যায়।

ক্ষেত্র বিশেষে টাকা বেশি হলে এজেন্টরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গিয়ে এ মাংস পৌঁছে দিয়ে আসে। এছাড়া প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অস্ত্র নিয়ে হরিণ শিকার বা শিকারের উদ্দেশে গহীন সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন এমন নানাবিধ ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেছে।

মংলাস্থ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মহিউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, নিয়মিত টহলের সময় ও অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় তারা জেলেদের কাছ থেকে হরিণে মাংস উদ্ধার করেছেন। এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড তাদের নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন।

শিকারীদের তৎপরতার কথা অস্বীকার না করলেও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) চৌধুরী আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা হরিণের মাংস বিক্রি বা পাচার রোধে আগের চেয়ে মনিটরিং আরও বাড়িয়েছি। বনজীবীদের নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বন ও আশপাশের এলাকায় এ ধরনের খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।’

এসময় তিনি আরো বলেন, ‘বন ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের জন্য সুন্দরবনকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) আওতায় আনার জন্য কাজ চলছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন ব্যবস্থাপনায় আরও গতি আসবে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে বনকর্মীদের কাজের গতিবিধি। ফলে সুন্দরবন এলাকার দস্যু, চোরা শিকারি, গাছ পাচারকারী ও অবৈধ জেলে-বাওয়ালীদের তৎপরতা কমে আসবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বনবিভাগের কোনো কর্মকর্তা এধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন বনকর্মীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।