ভাইরাস নাকি জলবায়ু পরিবর্তন? হিসেব মিলছেনা মৎস্য কর্তাদেরও !
পাইকগাছায় চিংড়ি ঘের গুলোতে মওসুমের শুরুতেই ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে মড়ক। চাষীরা কারণ হিসেবে ভাইরাস সংক্রমন বললেও মৎস্য অফিস বলছে মরা চিংড়িতে তারা কোন রোগ বালাইয়ের চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছেননা। কোন পদ্ধতিতেই রোধ করা যাচ্ছেনা বাগদা চিংড়ির এ মড়ক। জলবায়ু পরিবর্তনে অনাবৃষ্টি ও প্রচন্ড তাপদাহ চিংড়ির উপযোগী লবন পানির স্বাভাবিক পরিবেশকে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরাদের কেউ কেউ। এমন অবস্থায় চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের ভবিষ্যত নিয়ে নানাবিধ আশংকা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, গোটা উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমান ৩০ হাজার হেক্টর। যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতেই লবন পানির চিংড়ি চাষ হয়। মৎস্য অফিস জানায়, এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার চিংড়ি ঘের রয়েছে। গত বছরও উৎপাদন ভাল হয়নি। সেবার মৎস্য অধিদপ্তর চিংড়ি উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৬ হাজার মেট্রিক টন।
তবে গতবারের ন্যায় এবারো মওসুমের শুরুতেই ব্যাপক হারে চিংড়ি মাছ মারা যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন লক্ষমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে অন্যদিকে এবার পোনার দাম বেশি থাকলেও বাগদা চিংড়ির দাম ভাল না থাকায় আগামীতে চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন চাষীরা।
প্রসঙ্গত ৮০’র দশক থেকে কৃষি অধ্যুষিত এ উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয় লবন পানির চিংড়ি চাষ। শুরুতেই উৎপাদন ও দাম ভাল পাওয়ায় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে উপজেলার দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এর চাষাবাদ। সোনার ধান, সোনালী আঁশ, সবুজ সবজি আর শষ্যের পরিবর্তে দিগন্ত জোড়া মাঠের যে দিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। আর ফসলের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা নয়, সকাল-সন্ধ্যা ঝাঁঝালো গন্ধের চিকচিকে পানির নিচ থেকে উঠতে থাকে সোনাভরা বাগদা। কিছুদিনের মধ্যে পাইকগাছাকে চিংড়ি উৎপাদনের জন্য বিশেষায়িত করা হয় “সাদা সোনার রাজ্য” হিসেবে। রাতা-রাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যান চিংড়ি চাষের সাথে সম্পৃক্তরা। তবে প্রকৃত জমির মালিকদের অবস্থা চলে যায় আরো নীচের দিকে। ফসলও ফলেনা জমিতে আবার চিংড়ি ঘেরের হারিও (ভাড়া) কম। এক সময় ঋণের দায়ে জমিটুকু ঘের মালিকদের কাছেই বেঁচে দিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই।
তবে ১ থেকে দেড় দশকের মধ্যে ১৯৯৫ সালের পর থেকে চিংড়ি ঘেরে শুরু হয় “ভাইরাস” বা মড়ক রোগ সংক্রমন। ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করায় পুরোপুরি লাভের মুখে থাকা চিংড়ি শিল্পে নেমে আসে আকস্মিক ধ্বস। এভাবে সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের অনেকেই লাভের আশায় ধার-দেনা করে চাষাবাদ টিকিয়ে রেখে এক সময় চাপ সইতে না পেরে পালিয়ে গেছেন। অনেকেই সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। পরে কিছুটা ভাল হওয়ায় কোমর বেঁধে মাঠে নামেন চাষীরা। তবে মাত্র এক বছর পর মৌসুমের শুরুতেই চিংড়ি ঘেরে আবারো মড়ক অব্যাহত থাকায় নতুন করে বন্ধের উপক্রম হয়েছে সম্ভাবনাময় এ শিল্প।
চিংড়ি চাষী প্রতাপকাটী গ্রামের আমিনুল ইসলাম, কাশিমনগরের লিটু, আশরাফ, জাহাঙ্গির শেখ জানান, এবছর তাদের চিংড়ি ঘের থেকে এ পর্যন্ত তারা কোন মাছ ধরতে পারেনি। মওসুমের শুরুতেই তাদের ঘেরে মাছ মারা যাচ্ছে। অনেক ঘেরে প্রথম ও দ্বিতীয় দফার অবমুক্ত’র সকল মাছই মরে সাবার হয়ে গেছে। ব্যাপক হারে মড়ক আসলে কি ভাইরাস না অন্য কিছুর সংক্রমন তারা বুঝতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এ,এস,এম রাসেল জানান, যে সকল ঘেরের চিংড়ি মরছে ঐ সকল চিংড়িতে তারা কোন রোগের লক্ষণ বা চিহ্ন পাচ্ছেন না। তবে কি কারণে মরছে বিপুল পরিমান চিংড়ি? এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও ওই কর্তা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে অনাবৃষ্টি ও প্রচন্ড তাপদাহে চিংড়ির লবন পানির উপযুক্ত পরিবেশ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ার ফলে মাছের মড়ক লাগতে পারে।
এদিকে চিংড়ির মড়ক রোধে বিভিন্ন কোম্পানি বাহারি সব প্রচারে বাজারজাত করছে নানাবিধ প্রতিষেধক বা ওষুধ। অনেকে আবার পরিবেশ বান্ধবের ধুয়ো তুলে নিজেদেরকে চিংড়ি বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করলেও মূলত তাদের কারো কোন প্রেসক্রিপশনে কাজ না হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা।