Wednesday, December 4, 2013

কয়রার লবণ-প্রবণ জীবনধারায় নিরব বসন্ত

এখন তারা চালকের আসনে। তারা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই চিহ্নিত করছে। পরিকল্পনা করছে তা’ সমাধানের। নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। জনসংগঠন তৈরী করে পরনির্ভরশীল মানসিকতা ছিকায় তুলেছে। জনঅংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সোচ্চার হচ্ছে। তারা আইলাবিধ্বস্ত কয়রার মানুষ।

ঝড়-ঝঞ্জা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জন্য নিত্যনৈমত্যিক ঘটনা। সমুদ্রঘনিষ্ট উপকূল কয়রার জনপদে জলবায়ু পরিবর্তন নতুন আপদ। দিন যত যাচ্ছে জলবায়ুর বিপদাপন্নতা ততই প্রকট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দারুনভাবে প্রভাবিত করছে এই জনপদের মানুষকে। এখানকার মাটি, পানি, কৃষিসহ বেঁচে থাকার সব উপাদানই জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বিপদাপন্ন।

পরিবেশ-প্রতিবেশের এতসব বৈরী বাস্তবতার বিপরীতে কয়রার তৃনমূল মানুষ এখন অনেক সংগঠিত। নিজেদের ভালমন্দের বিষয়ে অনেক সচেতন। অন্যায় অবিচারে সোচ্চার। পরনির্ভর চিন্তাচেতনার বাইরে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে মনযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জনে দৃঢ়প্রত্যয়ী।

দুর্যোগের ঘনঘটায় সচারচর কাতর কয়রার তৃনমূল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে বিকল্প জীবনধারায় অভ্যস্থতা আনয়নে উন্নয়ন সংগঠন রূপান্তর এবং ওয়াটার-এইড আইলা পরবর্তী সময় হতে কয়রায় নিবিড় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

এই কার্যক্রমে প্রাধান্য পাচ্ছে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধির উন্নয়নসহ সামাজিক অনগ্রসরতা দূরীকরণ। এক কার্যক্রম পরিচালনায় কয়রার ৭টি ইউনিয়নের অন্ততঃ ১ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশী জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে যা কয়রা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ।

এই কার্যক্রমের ড্রাইভিং সিটে রয়েছে ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। ৯টি ইউনিয়নের ৬৩টি কমিটির ১৮৯০ জন সদস্য সকলেই নিজনিজ ওয়ার্ডে এখন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা খুবই সংগঠিত। নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করাসহ তা’ সমাধানে সতেষ্ট। এলাকার যে কোন উন্নয়নমুলক কাজে নিজেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। উন্নয়ন বাজেটে নিজেরা অংশগ্রহণ করছে। বৃক্ষরোপন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে। বিভিন্ন সামাজিক কাজেও অংশগ্রহণ করছে।

প্রতিটি কমিটি একটি উদ্ভাবনী কাজ করে এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা’ হলো- ‘ওয়াশ’ বিপদাপন্ন ম্যাপ। ওয়ার্ডের পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরী এই ম্যাপে এলাকার সার্বিক চিত্র বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। গৃহভিত্তিক পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য এই ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে এলাকার সমস্যা এখন সহজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে এবং সাথে সাথে সম্ভাব্য সমাধানসূত্রও আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে এই ম্যাপের মাধ্যমে। এ কারণে এই ম্যাপ এখন এলাকায় কর্মরত সকল উন্নয়ন সংগঠনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে- এটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বড় সাফল্য হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সহায়ক গ্রুপ হিসেবে রয়েছে ১৯০টি ইনফরমাল ক্লাব। মাদার্স ক্লাব, স্টুডেন্ট ক্লাব, ইয়ুথ ক্লাব, কিশোরী ক্লাব, পেশাজীবী ক্লাব ইত্যাদি নামে এই ১৯০টি ইনফরমাল ক্লাবের ৪ হাজার ৮শ’ ৭৯ জন নারী-পুরুষ নেতৃত্ব প্রদানে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক ধরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে যার মাধ্যমে কয়রার ৪৯,২৯১ পরিবারের ২ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে।

কয়রার ৬৩টি ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং ১৯০টি ইনফরমাল ক্লাব এখানকার প্রধান সমস্যা সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ পূরণে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। উন্নয়ন সংগঠন রূপান্তরের বাস্তবায়নাধীন ‘এডাপটিং ওয়াশ ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্রকল্পের প্রধান ‘অনুঘটক’ হিসেবে এই কমিটি কয়রার বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানির শতভাগ চাহিদা মিটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মোট কথা, ৬৩টি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৮৯০জন সদস্যসহ ১৯০ ইনফরমাল গ্রুপের ৪৮৭৯ জন নারী-পুরুষ তাবৎ কয়রার জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে বিকল্প জীবনপরিকল্পনা প্রণয়নে এক ধরণের জাগরণ তৈরী করতে পেরেছে। অনেকটা নিরব বসন্তের পরিবেশ যেন কয়রার লবণ-প্রবণ জীবনধারায়। এ ধারা অব্যাহত রাখতে দুর্যোগপ্রবণ কয়রার মানুষ এখন অনেক সক্ষম এবং আত্মপ্রত্যয়ীও।